ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম প্রথম আলোচনায় আসেন ২০১৪ সালে। ফার্মগেটে ওভারব্রিজকে তোয়াক্কা না করে যারা রাস্তা পারাপার হচ্ছিলেন তাদের নামমাত্র জরিমানা করে সচেতন করেছিলেন তিনি।
তার পরিচালিত অভিযানের মধ্যে অন্যতম হলো- ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ফকিরাপুলের ক্যাসিনোর আসরে অভিযান। সেপ্টেম্বরের ১৮ তারিখ ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদে অভিযান চালান তিনি। ১৪২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। উদ্ধার করা হয় ক্যাসিনো থেকে উপার্জিত অবৈধ ২৪ লাখ ২৯ হাজার টাকা।
একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর নিকেতনে যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের অফিসে অভিযানে যায় র্যাব। সেখানেও ছিলেন সারোয়ার আলম। অভিযানে জি কে শামীমের কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে অবৈধভাবে উপার্জিত নগদ এক কোটি ৮০ লাখ, ২০০ কোটি টাকার এফডিআর, বিদেশি ডলার, মদ ও অস্ত্র উদ্ধার করেন তিনি।
২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার হাতিরপুলে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানিকে নকল করে বাংলাদেশে উৎপাদনের কারখানায় হানা দেন সারোয়ার আলম। হাতেনাতে ধরে সিলভান ট্রেডিং কো. এবং টোটাল ফার্মাকে ৪০ লাখ টাকা জরিমানা ও ২ জনকে জেল দেন তিনি।
কুকুর ও পশুর মেয়াদোত্তীর্ণ ভ্যাকসিন-
২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট ফকিরাপুলের একটি ভবনে গিয়ে কুকুরসহ অন্যান্য পশুর মেয়াদোত্তীর্ণ ভ্যাকসিন বিক্রির চিত্র ধরা পড়ে তার চোখে। অভিযানে গিয়ে দেখেন, ২০১২ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া জলাতঙ্ক, বার্ডফ্লুর ভ্যাকসিন ২০১৯ সালে কুকুরের দেহে দেয়ার অভিনব প্রতারণার চিত্র। সব যাচাইবাছাই করে অ্যাডভান্স অ্যানিম্যাল সায়েন্স কোং লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের ৬ জনকে জেল ও ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করেন তিনি। জব্দ করেন আরও ১০ কোটি টাকার মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ।
ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত-
ঢাকায় যখন বিভিন্ন কিশোর অপরাধী ও গ্যাংয়ের দ্বারা হত্যাকাণ্ড, চুরি-ছিনতাই বেড়ে যায় তখন তাদের শনাক্তে অভিযান চালান সারোয়ার আলম। গত বছরের ৩১ জুলাই রাজধানীর শ্যামলী, শিশুমেলা, কলেজগেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২৯ কিশোরকে আটক করে ৬ মাসের জন্য কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রে পাঠান তিনি।
পশুর হাটে হানা-
৯ আগস্ট গাবতলীর কোরবানির পশুর হাটে হানা দেন সারোয়ার আলম। হাতেনাতে ধরেন একজন পশু চিকিৎসককে। ওই চিকিৎসক গরুকে মোটাতাজাকরণ স্টেরয়েড ইনজেকশন দিচ্ছিলেন। ৬ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয় তাকে।
দুধে ভেজাল-
২০১৯ সালের ৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে বারো আউলিয়া ডেইরি মিল্ক অ্যান্ড ফুড লিমিটেডে অভিযান চালান তিনি। গিয়ে দেখেন- ১০০ লিটার দুধের সঙ্গে পানি, স্কিম মিল্ক পাউডার এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে ২ হাজার ৮০০ লিটার পাস্তুরিত দুধ তৈরির চিত্র। প্রতিষ্ঠানের পরিচালকসহ ১২ জনকে কারাদণ্ড এবং ৫৮ লাখ টাকা জরিমানা করে ফ্যাক্টরি সিলগালা করেন তিনি।
ডেঙ্গু পরীক্ষার সরকারি ফি-
২০১৯ সালের জুলাই মাসে সারাদেশ যখন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত তখন হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু ও সিবিসি পরীক্ষায় ইচ্ছেমতো ফি আদায় করছিল। সংবেদনশীল এই বিষয়ে অভিযান শুরু করেন সারোয়ার আলম। ৩১ জুলাই ডেঙ্গু পরীক্ষায় সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি নেয়া এবং টেস্ট না করে প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট দেয়ায় পল্টন এবং ফকিরাপুল এলাকায় চারটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৫ জনকে জেল, ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করে দুই প্রতিষ্ঠান সিলগালা করেন।
উত্তরার নামিদামি হাসপাতালে অভিযান-
এ বছরের ২৯ জুলাই উত্তরার ক্রিসেন্ট, আরএমসি এবং লুবনা হাসপাতালে অভিযান চালান সারোয়ার আলম। গিয়ে দেখেন টেস্ট না করেই দেয়া হয় মাইক্রোবায়োলজিক্যাল ও কালচার টেস্ট রিপোর্ট। রিপোর্টের ফাঁকা পাতায় অগ্রিম স্বাক্ষর দেয়া। ভেতরে ৩৪ টাকা ৫০ পয়সার প্যাথেড্রিন বিক্রি হচ্ছিল ৩৫০ টাকায়, ৪ টাকার ওষুধ ১০০ টাকায়। ল্যাব আর অপারেশন থিয়েটারে পাওয়া গেল মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট এবং সার্জিক্যাল সামগ্রী। এসব কারণে উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালকে ১৭ লাখ, লুবনা হাসপাতালকে ২০ লাখ এবং আরএমসি হাসপাতালকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করেন তিনি।
২৫ জুলাই ধোলাইপারে কিউর জেনারেল হাসপাতালে অপারেশন করার সময় এইচএসসি পাস দুই ভুয়া ডাক্তারকে আটক করেন তিনি।
হজের টিকিটে জালিয়াতি-
সিন্ডিকেট করে সৌদি এয়ারলাইনসের টিকিট কিনে হজযাত্রীদের কাছ থেকে বেশিমূল্যে বিক্রির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন তিনি। মেয়াদোত্তীর্ণ কসমেটিকস বিক্রির জন্য গুলশানের পারসোনা বিউটি পার্লার ও ফারজানা শাকিল বিউটি পার্লারকে ৩০ লাখ টাকা জরিমানা করেন।
২৭ মে গরুর মাংসে রঙ ব্যবহারের জন্য নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে অভিযানে গিয়ে জেল জরিমানা করেন তিনি।
বিজিবির সীমান্ত স্কয়ারের ফুডকোর্টের চারিদিকে র্যাব সদস্য দ্বারা কর্ডন করে অভিযান চালান সারোয়ার আলম। গিয়ে দেখেন- কাপড়ে ব্যবহার্য রঙ, আর সহস্র তেলাপোকা। জেল জরিমানা করেন তাদের।
নকল কসমেটিকসের বিরুদ্ধে চকবাজার, কেরানীগঞ্জ ও ডেমরা এলাকায় কমপক্ষে ১২টি অভিযান চালিয়েছেন তিনি।
বাদামতলী ও কারওয়ান বাজারে একাধিক অভিযান চালান তিনি। এ সময় কাঁচা আমকে হলুদ করে বিক্রি এবং মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুর বিক্রির চিত্র উঠে আসে সবার সামনে।
চাঁদাবাজ হাতি-
২০১৯ সালের মে মাসে কারওয়ান বাজারে একটি অভিযান চালানোর সময় সড়কে গাড়ি ঠেকিয়ে, মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজির চিত্র চোখে পড়ে সারোয়ার আলমের। তখনই দুই হাতি ও মাহুতকে থামার নির্দেশ দেন তিনি। তবে মাহুত না থেমে দৌড়াতে থাকেন, পেছনে দৌড়েছেন তিনিও। অবশেষে হাতিরঝিলে গিয়ে আটকান তাদের। দুজনকে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেন।
পুরান ঢাকার কেমিক্যাল-
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে বিস্ফোরণে পুরান ঢাকায় আগুন লাগার পর থেকে একের পর এক ক্ষতিকারক কেমিক্যাল কারখানা সরানোর অভিযান চালান তিনি।
অ্যাপোলো, ইউনাইটেড, পপুলারসহ নামিদামি হাসপাতালে অভিযান-
২০১৮ এবং ২০১৯ সালজুড়েই বড় বড় হাসপাতালে অভিযান চালান সারোয়ার আলম। অভিযানে মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট (রাসায়নিক উপাদান) ব্যবহার ও অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রির অভিযোগে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালকে ২০ লাখ টাকা, অ্যাপোলো হাসপাতালকে ৫ লাখ ও পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করেন।
এছাড়াও অভিযান চালিয়ে একই অভিযোগে পান্থপথের বিআরবি হাসপাতাল, শমরিতা হাসপাতাল ও বাংলাদেশ স্পাইন হাসপাতালকে ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করেন।
নানা অনিয়মের অভিযোগে চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালকেও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন তিনি।
সারোয়ার আলমের এমন সাফল্যের জন্য ২০১৯ সালের ১২ মে তার মাকে ‘গর্বিণী মা’ পদক পরিয়ে দেন জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
অসাধারণভাবে কাজ করে চলা সারোয়ার আলমকে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। এতদিন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা সারোয়ার আলম এখন থেকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করবেন।