ইয়াসের আহমেদ এখন আর স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন না। ভয় পান।
ছোট ছোট দু’টো ছেলে, মেয়েকেও ছেড়ে থাকতে হয় তাকে। জানতে পারলে তো তাকে দিবারাত্র জ্বালিয়ে মারবেন স্ত্রী! জানতে চাইবেন, তার একটা কিডনি কোথায় গেল? সেটা তিনি খোয়ালেন কীভাবে? টাকার লোভে?
স্ত্রী তো আর তখন বুঝতে চাইবেন না, ইয়াসের প্রথমে পড়েছিলেন ফাঁদে। একটা দুষ্ট চক্রের খপ্পরে। কাজ জোটানোর আশায় গিয়ে দারুণভাবে ঠকেছিলেন। টাকা কামানোর জন্য তখন উঠেপড়ে লেগেছিলেন তিনি। ধারকর্জে যে ডুবে গিয়েছিল মাথা। ফলে, টাকার লোভেও পড়েছিলেন। তাকে ভয়ও দেখানো হয়েছিল। তার জন্যই খুইয়েছিলেন তার একটি কিডনি।
ইয়াসের এখনও জানেন না, দুষ্ট চক্রের হাতে তার একটি কিডনি তুলে দেওয়ার জন্য একটি আন্তর্জাতিক কিডনি চক্রের সঙ্গে এখন তিনিও অভিযুক্ত। তার বাঁ দিকের কিডনিটি বেঁচেছিলেন ভারতের মালাড়ের বাসিন্দা পঙ্কজ রাওকে।
স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ৭ লাখ টাকা ধার হয়েছিল ইয়াসেরের। ২০১১ সালে। নিজের গ্রাম ভেলোরে অটো রিকশা চালিয়ে আর কতই বা রোজগার হত ইয়াসেরের। সেই রোজগারে ৭ লাখ টাকার ধার মেটানো সম্ভব হত না তার। তাই ভালো কাজের খোঁজে ২০১৪ সালে পাড়ি জমিয়েছিলেন মুম্বাইয়ে। ভেবেছিলেন সেই মুল্লুকে গেলে ভালো টাকা কামানো যাবে। সেখানে ট্যাক্সি চালাতেন। কিন্তু তাতে খুব একটা রোজগার হত না ইয়াসেরের।
ফলে, হন্যে হয়ে একটা ভালো মাইনের চাকরি খুঁজতে শুরু করলেন। দরখাস্ত পাঠাতে শুরু করলেন এখানে ওখানে। চাকরির একের পর এক অ্যাপ্লিকেশন পাঠানো শুরু করলেন, ইন্টারনেটে। আর সেই ভাবেই তার যোগাযোগ হল আমদাবাদের শিক্ষা কনসালটেন্সির সঙ্গে। ইয়াসের তখন জানতেন না, ওই কনসালটেন্সি চালান একটি আন্তর্জাতিক কিডনি চক্রের মাস্টার মাইন্ড সুরেশ প্রজাপতি।
ইয়াসেরের কথায়, প্রথমে আমি আমদাবাদে যাই। ২০১৫-র জুনে। সেখানে আমাকে তোলা হয় ‘আকাশ লজ’-এ। তারপর সেখানে হঠাৎই নমুনা পরীক্ষার জন্য আমার কাছে রক্ত চাওয়া হয়। অবাক হয়ে জানতে চাই, রক্ত দিতে হবে কেন? ওরা বলে, বিদেশে চাকরি জোটাতে হলে শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা দেওয়াটা জরুরি। আর তার জন্যই রক্ত দিতে হবে আমাকে। তারপরই দ্রুত চাকা গড়াতে শুরু করে। জুলাইয়েই আমাকে পাঠানো হয় কায়রোয়। বলা হয়, সব রেডি। উবের চালাতে হবে। ওখানে গেলেই চাকরি হয়ে যাবে। কিন্তু আমি ৯৯ শতাংশ ঠকেছিলাম। আর বাকি ১ শতাংশ ছিল আমার লোভ।
কায়রোতে তাকে স্বাগত জানিয়েছিল মধু নামে একজন। ইয়াসের জানিয়েছেন, মধুই তাকে একটা অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে ছিলেন আরও পাঁচজন। পরের দিনই ইয়াসেরকে নিয়ে যাওয়া হয় নীল বাদরাওই হাসপাতালে। বলা হয়, সেখানে তাকে নানা রকমের রক্ত পরীক্ষা করানো হবে। করানো হবে মাথার স্ক্যানও। সেখানেই টাকার লোভ দেখিয়ে তার শরীর থেকে নেওয়া হয় ডান পাশের কিডনিটিও।
একটি কিডনি বেচলেও ইয়াসের কিন্তু হাতে পেয়েছিলেন সামান্য কিছু অর্থ। উবেরের চাকরি তার ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গিয়েছিল।
চাকরির লোভে একটি কিডনি খুইয়ে এখন চেন্নাই থেকে অনেক দূরে তালোজা গ্রামে স্ত্রী, ছেলে, মেয়েকে ফেলে রেখে ভেলোরে মা, বাবার কাছে থেকে অটোরিকশা চালিয়ে যৎসামান্য রোজগারে বাঁচতে হচ্ছে ইয়াসেরকে। সেই টাকাতেই দেখাশোনা করতে হচ্ছে মা, বাবার। দূরে থাকা স্ত্রীর হাতেও ঠিক সময়ে পৌঁছে দিতে হচ্ছে টাকা, সংসার চালানোর জন্য।