সিনহা হত্যার নেপথ্যে ‘অসৎ উদ্দেশ্য’: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার নেপথ্যে ‘অসৎ উদ্দেশ্য’ ছিল বলে মন্তব্য করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত উচ্চ পর্যায়ের যৌথ তদন্ত কমিটি। গত ৩১ জুলাই কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে সিনহার নিহত হওয়ার ঘটনাটি তাৎক্ষণিক নাকি পূর্বপরিকল্পিত এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

সূত্র বলছে, এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দেয়া হয়নি। তবে হত্যাকাণ্ডে সিনহা ও তার সহকর্মীরা তথ্যচিত্রের জন্য যে ভিডিও ধারণ করেছিলেন তার যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মনে করে তদন্ত কমিটি।

তদন্ত রিপোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সিনহা নিহত হওয়ার পর কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের  নির্দেশে ঘটনা ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া এ ঘটনার পর এসপি সংবেদনশীল আচরণ করতে পারেননি। পুলিশ সুপারের জবাবদিহিতা ও তদারকির ঘটতি ছিল বলেও তদন্ত কমিটির রিপোর্টে উঠে এসেছে।

তদন্ত কমিটির ১৩ সুপারিশ
সরেজমিন তদন্ত করে ঘটনার কারণ, উৎস অনুসন্ধান এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় ঠিক করতে নির্দেশনা দিয়ে গত ১ আগস্ট তদন্ত কমিটি পুনর্গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তদন্ত কমিটি টানা ৩৫ দিনের তদন্ত শেষে সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে ৮০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন, ৫৮৬ পৃষ্ঠার ৬৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য এবং ২১ পৃষ্ঠার ঘটনা সংশ্লিষ্ট ছবি তুলে দেয়।

এফবিআই’র আদলে আলাদা তদন্ত সংস্থা করার সুপারিশ:

তদন্ত কমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পুলিশের প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র একটি তদন্ত সংস্থা গঠন করার পরামর্শ দিয়েছে। তদন্ত কমিটির মতে সম্প্রতি বেশ কিছু ঘটনায় পুলিশের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এজন্য পুলিশি তদন্ত নিয়ে জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তাই কোনো কোনো ‘স্পর্শকাতর’ ঘটনায় নিরপেক্ষ কোনো সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করার প্রয়োজন দেখা দিলে এফবিআই’র আদলে গঠিত তদন্ত সংস্থা তদন্ত করতে পারবে। বর্তমানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ বা ডিবিসহ যত তদন্ত সংস্থা রয়েছে সব পুলিশ বাহিনী নিয়ন্ত্রিত তদন্ত সংস্থা।

তদন্ত কমিটি তাদের সুপারিশে পুলিশের অস্ত্র ও গুলির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করারও তাগিদ দিয়েছে। কক্সবাজারে মাদক নির্মূলে একটি স্বতন্ত্র ও সমন্বিত প্রস্তাব দিয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার পর যথাযথ তদন্ত ও তার তদারকি নিশ্চিত করারও পরামর্শ দিয়েছে।

বন্দুকযুদ্ধে ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতেন ওসি প্রদীপ

তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সময় ১০৬টি বন্দুকযুদ্ধে ১৭৪ জন নিহত হন। প্রদীপ তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন, বেশিরভাগ বন্দুকযুদ্ধ তার নেতৃত্বেই হতো। এরমধ্যে ২০-৩০ বার তিনি ব্যক্তিগত অস্ত্র দিয়ে গুলি বর্ষণ করেছেন। বন্দুকযুদ্ধে তার ব্যক্তিগত অস্ত্রের ব্যবহার কক্সবাজার জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানতেন বলেও তদন্ত কমিটির কাছে দাবি করেছেন ওসি প্রদীপ।

তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আদালতের নির্দেশে সিনহা হত্যা মামলার পুলিশি তদন্ত চলায় তারা প্রকাশ্যে কিছু জানাতে পারবেন না। তবে আদালত চাইলে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের নামে অভিযোগ আসবে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে তা গণমাধ্যমকে জানানোর আশ্বাস দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে-এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সিনহা হত্যার ঘটনায় দুই বাহিনীর মধ্যে গুজব ছড়িয়ে উত্তেজনা সৃষ্টির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলেও মন্তব্য করেন মন্ত্রী।

টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও সিনহার ওপর গুলিবর্ষণকারী ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীর রিমান্ডে নির্যাতন করার অভিযোগের ভিডিও সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। সে সময় তথ্য ভিত্তিক সংবাদ ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করা হয় না বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী।

তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, পুলিশ বাহিনী আইনশৃঙ্খলার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে। এ ঘটনা কোনোভাবেই সেটিকে ম্লান করবে না।

গত ৩১ জুলাই কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের নিহতের ঘটনায় পুলিশের বয়ান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় ১ আগস্ট ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই দিন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ উচ্চ পর্যায়ের যৌথ তদন্ত কমিটি গঠনের অনুরোধ জানালে সেনা ও পুলিশ বাহিনীর প্রতিনিধিসহ চার সদস্যের কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। তিন দফা সময় বাড়ানোর পর এ তদন্ত কমিটি ৩৫ দিনে মোট ৬৮ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছে। ঘটনার অন্যতম প্রধান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সাক্ষাৎকার নিতেই তদন্ত কমিটিকে দু’দফায় সময় বাড়াতে হয়।

তদন্ত কমিটির প্রধান জানিয়েছেন, পুলিশ ও এপিবিএনের সদস্য, শামলাপুর চেকপোস্টের ঘটনাস্থলের আশপাশে প্রত্যক্ষদর্শী এবং সিনহা রাশেদ ও তার সহকর্মী সিফাত যে পাহাড়ে উঠেছিলেন সেই মারিশবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দাদেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছে তদন্ত কমিটি।

পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান ইউটিউব চ্যানেল জাস্ট গোর জন্য তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য তিন সহকর্মীকে নিয়ে ৩ জুলাই কক্সবাজারে যান। হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্টে কাজের সূত্রে অবস্থান করছিলেন তারা। ঘটনার দিন রাতে মারিশবুনিয়া পাহাড় থেকে শুটিং করে ফেরার সময় শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা। সে রাতেই নীলিমা রিসোর্টে অভিযান চালায় পুলিশ। সিনহার সহকর্মী শিপ্রাকে মাদক মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ। অন্যদিকে একমাত্র সাক্ষী সিফাতকে হত্যা মামলা ও মাদক মামলায় গ্রেফতার করা হয়। পরে তারা দুজনই জামিনে মুক্তি পান।

এদিকে সিনহার বড় বোন শাহরিয়া শারমিন ওসি প্রদীপ, ইন্সপেক্টর লিয়াকতসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। বেশ কয়েক দফা রিমান্ড শেষে ওসি প্রদীপসহ আসামিরা এখন কারাগারে।