দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহৎ চামড়ার মোকাম যশোরের রাজারহাট চাঙা হলেও মলিন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মুখ। শনিবার (০৮ আগস্ট) ঈদ-পরবর্তী বড় হাটে দুই কোটি টাকার চামড়া বেচাকেনা হলেও তাতে চালান বাঁচেনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনেও হাটে দাম পাচ্ছেন না। পাইকারি ব্যবসায়ীরা যে দাম বলছেন, তা নির্ধারিত দামের চেয়ে কম। তবে কিছুটা বেড়েছে চামড়ার দাম।
যশোরের রাজারহাটে শনিবার বসেছিল ঈদ-পরবর্তী চামড়ার দ্বিতীয় হাট। মঙ্গলবার প্রথম চামড়ার হাট না জমলেও শনিবার ছিল জমজমাট। ট্যানারি প্রতিনিধি ও বাইরের ব্যাপারীদের সমাগম এবং চামড়ার সরবরাহও ছিল প্রচুর। বিক্রিও হয়েছে প্রায় সব চামড়া। হাটের ইজারাদারের হিসেবে এদিন প্রায় প্রায় ৫০ হাজার পশুর চামড়া বাজারে আসে। কেনাবেচা হয়েছে অন্তত দুই কোটি টাকার চামড়া।
রাজারহাটের ইজারাদার হাসানুজ্জামান হাসু বলেন, যশোরের রাজারহাটে খুলনা বিভাগের ১০ জেলা ছাড়াও বিভিন্ন জেলা থেকে আসা চামড়া কেনাবেচা হয়। সপ্তাহে দুদিন মঙ্গল ও শনিবার চামড়া নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা। ঈদ-পরবর্তী দ্বিতীয় হাট শনিবার সকাল থেকেই ছিল ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাক। এদিন প্রথম হাটের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে। দুপুর ১২টার মধ্যেই হাটে আসা প্রায় সব চামড়া বিক্রি হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, হাটে প্রায় ৩৫ হাজার গরুর চামড়া উঠেছে। ছাগলের চামড়া এসেছিল প্রায় ১৫ হাজার। বাজার কর্মকর্তা, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তাসহ আমরা হিসাব করে দেখেছি প্রায় দুই কোটি টাকার চামড়া বেচাকেনা হয়েছে আজ।
যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারি আলাউদ্দিন মুকুল বলেন, শনিবার বাজার জমজমাট ছিল। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আশানুরূপ দামে চামড়া বিক্রি করতে না পারলেও কেউ ফেরত নিয়ে যাননি।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামে নয়; চামড়া বিক্রি হয়েছে আকারভেদে-আপেক্ষিক মূল্যে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় ব্যবসায়ী বা গ্রাম থেকে যে দামে চামড়া কিনেছেন হাটে সেই দামও পাননি তারা।
যশোরের মণিরামপুরের চিনেটোলা গ্রামের স্বদেশ দাস বলেন, ১০০ গরুর চামড়া বিক্রির জন্য হাটে আনি। সরকার গরুর চামড়ার দাম ২৮ থেকে ৩২ টাকা ফুট নির্ধারণ করলেও হাটে ফুট হিসেবে চামড়া বিক্রি হয়নি। গরুর চামড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি করেছি। অথচ সরকার নির্ধারিত দাম হলে মূল্য পেতাম ৭০০ টাকা করে। আমরা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা গত বছরের মতো এবারও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলাম।
একই কথা বলেন খুলনার ফুলতলার ব্যবসায়ী বিমল দাস। তিনি বলেন, ব্যবসা করার কোনো পরিবেশ নেই। ২৪টি ছাগলের চামড়া বিক্রি করেছি ৪২০ টাকা। অর্থাৎ ১৭ টাকা প্রতি পিস বিক্রি হয়েছে। লবণ খরচও পেলাম না।
মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাইকারিতে চামড়া কেনা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা লাভের মুখ দেখবেন বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, দূর-দূরান্ত থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা হাটে পরিবহন খরচ করে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। কাঙ্ক্ষিত দাম না পেলে চামড়া নিয়ে আবার ফিরে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে চামড়া সংরক্ষণসহ অন্যান্য খরচ বেড়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে চামড়া বিক্রি করেই ফিরতে হয়েছে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের।
ঝিকরগাছার আড়শিংড়ি গ্রামের শহিদুল ইসলাম ৫৬ পিস গরুর চামড়া ও সাড়ে ৫০০ পিস ছাগলের চামড়া নিয়ে রাজারহাটে আসেন। তিনি বলেন, গরুর চামড়া কেনা ৫০০ টাকা পিস। দাম উঠেছে ২৫০ টাকা। আর ছাগলের চামড়ার দাম দিতে চাইছেন পিস ৫০ টাকা। চামড়া বিক্রি না করে ফিরে গেলে খরচ আরও বেড়ে যাবে।
মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলা থেকে ৩৫০ পিস গরুর চামড়া নিয়ে আসেন ব্যবসায়ী নূর ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতি পিস আকার ভেদে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা দাম বলেছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এর দাম হওয়া উচিত ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা।
ঝিনাইদহ থেকে চামড়া নিয়ে আসা আবদুর রশিদ বলেন, ঈদের পরে প্রথম হাটের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দাম পাওয়া যাচ্ছে। তা না হলে চামড়া ফেলে বাড়ি ফিরতে হতো আমাদের।
এদিকে, পাইকারি ব্যবসায়ীরা আছেন অন্য দুঃশ্চিন্তায়। তারা ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে বকেয়া পাননি। নতুন করে আবার চামড়া কিনছেন। এগুলো কত করে বিক্রি করতে পারবেন তার নিশ্চয়তা নেই। বিক্রি করে নগদ টাকা পাবেন কিনা সেটাও অনিশ্চিত। এমন তথ্য দিলেন রাজারহাটের পাইকারি ব্যবসায়ী আবদুল ওহাব।
তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকের কাছে আমার পাওনা রয়েছে ৭০ লাখ টাকা। এবার কোরবানির আগে মাত্র এক লাখ টাকা দিয়েছে তারা। ক্রয় করা চামড়া নগদে বিক্রি করতে না পারলে পথে বসতে হবে।
ঝিনাইদহের ব্যাপারীপাড়ার আজিজার রহমান বলেন, ঢাকার সীমান্ত লেদারের কাছে আমার পাওনা রয়েছে ৩৯ লাখ ছয় হাজার টাকা। কিন্তু বকেয়া টাকা পাচ্ছি না। এরই মধ্যে আবার চামড়া কিনলাম।