বরিশাল নগরীতে শিশু নির্যাতনের ঘটনা ১০ হাজার টাকায় সমঝোতা

লেখক:
প্রকাশ: ৫ years ago

বরিশালে মাত্র ১০ হাজার টাকায় ধামাচাপা পড়লো নগরীর ধানগবেষণা এলাকায় চুরির অপবাদে শিশু নির্যাতনের ঘটনা। গতকাল শনিবার রাতে সালিস বৈঠকে শিশুটির চিকিৎসা বাবদ অভিযুক্তকে ওই টাকা জরিমানা ধার্য করে দেন স্থানীয় কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা। এসময় থানা পুলিশের একজন কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাছাড়া সালিসদারদের জরিমানার বিষয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত নির্যাতনের শিকার শিশুর পরিবার মেনে নিয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ।

এর আগে গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নগরীর ধানগবেষণা সড়কে জিসান নামের ১১ বছর বয়সী শিশু শিক্ষার্থীকে চুরির অপবাদ দিয়ে নির্মম নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। যা নিয়ে শনিবার দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে ঘটনাটি বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের নজরে আসে। পরবর্তীতে তার নির্দেশে কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়।

থানা পুলিশ জানিয়েছে, ‘সকালে সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (কোতয়ালী) মো. রাসেল ও থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুর রহমান মুকুলসহ পুলিশের টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এসময় তারা নির্যাতিত শিশু জিসান, অভিযুক্ত পারভেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি ভিডিও রেকর্ড করে। পরে ঘটনাটি নিয়ে তারা আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও স্থানীয় কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতারা বিষয়টি সালিস মীমাংসার মাধ্যমে সমঝোতার আশ্বাস দেন। এর প্রেক্ষিতে বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধানের জন্য ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শরীফ মো. আনিসুর রহমান ও একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল হুদাকে দায়িত্ব দেয়া হয়।

এদিকে শিশু নির্যাতনের ঘটনায় শনিবার রাতে কাউন্সিলর কার্যালয়ে সালিস মীমাংসা হয়েছে। যেখানে সালিসদারদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিশুটিকে চিকিৎসা খরচ বাবদ মাত্র ১০ হাজার টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে কোন ধরনের বাড়াবাড়ি না করার জন্যও শিশুর পরিবারকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন সালিসদাররা।

এ প্রসঙ্গে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শরীফ আনিসুর রহমান এর বক্তব্য জানতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। তবে একই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল হুদা বলেন, ‘সালিস বৈঠকে পুলিশের একজন কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। তার উপস্থিতিতেই সব কিছু করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কারো উপর কোন চাপ সৃষ্টি করা হয়নি। বরং উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমেই সকল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ঘটনার পরে শিশুটিকে হাসপাতালে নেয়া, ভর্তি এবং চিকিৎসা বাবদ পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়েছে। তাছাড়া পরবর্তী চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রে থাকা ওষুধের মূল্য সাড়ে ৩শত টাকার মতো আসে। তার পরেও পরবর্তী চিকিৎসা বাবদ আরও ৫ হাজার টাকাসহ মোট ১০ হাজার টাকা চিকিৎসা খরচ দেয়া হয়েছে শিশুর পরিবারকে। যা তারা স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েছে।

এদিকে সালিস বৈঠকে উপস্থিত থাকা কোতয়ালী মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আরাফাত রহমান হাসান বলেন, ‘শিশুটিকে মারধর করা হয়েছে এটা যেমন সত্যি, তেমনি শিশুটি যে টাকা চুরি করেছে তাও সত্যি। উভয় পক্ষই নিজেদের দোষ স্বীকার করে নিয়েছে। তার পরেও শিশুটিকে মারধর করে অপরাধ করেছেন পারভেজ নামের দোকানি। এ কারণে সালিস বৈঠকের মাধ্যমে তাকে জরিমানা হিসেবে চিকিৎসা খরচ বাবদ ১০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এতে শিশুর পরিবারও সম্মতি প্রকাশ করেছে। এখানে কারো উপর কোন চাপ সৃষ্টি করা হয়নি বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

তবে স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর পরই নির্যাতনকারী দোকানি পারভেজ স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের লোকের প্রভাব খাটিয়ে অসুস্থ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা না যেতেই শনিবার শিশুটিকে হাসপাতাল থেকে নাম কাটিয়ে বাসায় নিয়ে আসেন। এমনকি সাংবাদিকদের কাছে নির্যাতনের বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করায় শিশুর পরিবারকে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। যার কারণে সালিস বৈঠকে দেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

প্রসঙ্গত, শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নগরীর ধানগবেষণা রোডের মুদি দোকান থেকে ৪৩ হাজার টাকা চুরির অপবাদ দিয়ে সাগরদী সরকারি প্রাইমারি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র জিসানকে ধরে নিয়ে হাত বেধে নির্মম নির্যাতন করা হয়। শিশুটি ওই এলাকার আক্কেল মিয়ার দোকান সংলগ্ন হারুনের বাসার ভাড়াটিয়া দিনমজুর শাহজাহান মিয়ার ছেলে। এছাড়া অভিযুক্ত দোকানি পারভেজ একই এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ফারুকের পুত্র। অভিযুক্ত পারভেজ ঘর থেকে ধরে এনে হাত বেধে দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকে নির্যাতনের ফলে বমি এবং মল-মূত্র ত্যাগ করে দেয় শিশুটি। পরে পরিবারের সদস্যরা প্রথমে স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছে অভিযোগ এবং পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন।