১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে মুখিয়ে ছিল সারাদেশ। তৎকালীন ১৫ দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার আগমনের প্রহর গুনছেন হাজার হাজার ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী জনতা। শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে একটি খোলা জিপে চড়ে সমাবেশস্থলের দিকে আসছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, সঙ্গে মিছিল নিয়ে কয়েক হাজার নেতাকর্মী।
দুপুর দেড়টার দিকে মিছিলটি কোতোয়ালি থানা অতিক্রম করে পুরান বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন অতিক্রম করছিল। এ সময় স্বৈরশাসকের পেটোয়া বাহিনী মুক্তিকামী জনতার উন্মাতাল জনজোয়ার দেখে ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। সমাবেশ বানচাল করতে তৎকালীন সিএমপি কমিশনার রকিবুল হুদার নির্দেশে মিছিলটি ঘিরে ফেলে পুলিশ ও বিডিয়ার সদস্যরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গর্জে ওঠে পুলিশ বাহিনীর রাইফেল। দলের নেতাকর্মীরা মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে নেত্রীকে বাঁচাতে মানববর্ম রচনা করেন। অতর্কিত গুলিতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী এবং আইনজীবী, চিকিৎসকসহ অন্তত ২৪ জন নিহত হন। আহত হন আরও প্রায় তিন শতাধিক।
নৃশংসতার একপর্যায়ে চলে লাশ গুমের চেষ্টা। পুলিশের কড়া পাহারায় নিহতদের রাতের আঁধারে নগরের অভয়মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
নির্মম ওই হত্যাকাণ্ডের ৩২ বছর পূর্ণ হওয়ার চারদিন আগে রায় ঘোষণা করা হয়। সোমবার বিকেল ৩টার কিছু পরে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ (ভারপ্রাপ্ত) ইসমাইল হোসেনের আদালত রায়ে পাঁচজনকে ফাঁসির আদেশ দেন। রায়ে আদালত ৩২৬ ধারায় পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড প্রদানেরও আদেশ দেন।
এ রায়কে ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতি উৎসাহী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত’ বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন আদালত।
সেন্সরশিপের শক্ত বেড়া ডিঙিয়ে চট্টগ্রামে সেদিনের বিভীষিকার সেই খবর তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে রোমহর্ষক যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা তুলে ধারার চেষ্টা করেছিলেন ‘এখনই সময়’ নামে একটি পত্রিকার তৎকালীন চট্টগ্রাম প্রতিনিধি সৈয়দ মুহম্মদ আবুল হাসেম।
তিনি তার রিপোর্টে প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে লেখেন, ‘পুলিশের ঘন ঘন গুলি বর্ষণে বিপণিবিতান (নিউ মার্কেট), তিনপুলের মোড়, দারুল ফজল মার্কেট, স্টেশন রোড ও ল্যায়াল রোড এলাকায় কমপক্ষে ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হন। তাদের মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে মারা যান দুজন। হাসপাতালে মৃত্যু হয় আটজনের।’
তবে তিনি আরও এক প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে লেখেন, ‘মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। পুলিশ ও বিডিআর দীর্ঘ চার ঘণ্টা ধরে গুলি বর্ষণ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জের মাধ্যমে এক তাণ্ডবলীলার সূত্রপাত ঘটায়। এতে ১১ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হন এবং ২০০ এর বেশি ছাত্র-জনতা আহত হন। পনের দলীয় জোটের শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করা হয় যারা আবার আহত।’
সেদিনে পুলিশের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে তাদের হাতেই আটক হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন দফতর সম্পাদক ফরিদুল আলম খান। মামলার রায় ঘোষণার আগে সেদিনের বিভীষিকাময় স্মৃতি স্মরণ করে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিকেলে সমাবেশ হলেও সকালেই ক্যাম্পাস থেকে শহরে চলে আসি। দুপুর দেড়টা বা ২টার দিকে তৎকালীন ১৫ দলীয় জোটনেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে সমাবেশস্থলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কোতোয়ালি থানা পার হয়ে ছাত্র-জনতা পুরান বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনের রাস্তায় আসার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। এ সময় মুক্তিকামী জনতার উন্মাতাল জনজোয়ার দেখে ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে পেটোয়া বাহিনী। মুখোশ পরা কয়েকজন গিয়ে শেখ হাসিনার মাথায় পিস্তল তাক করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গর্জে উঠে পুলিশের রাইফেল। নেত্রীকে বাঁচাতে চারপাশে তৈরি করা হয় মানববর্ম। এর মাঝেই একে একে শহীদ হতে থাকেন আমাদের সাথীরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটি গুলি আমার পায়ের হাড় গুঁড়িয়ে দেয়। লাফ দিয়ে পড়ে যাই পাশের নালায়। আমার মতো অনেকেই জীবন বাঁচাতে নালাতে লাফ দিয়েছিল। কিন্তু পাষণ্ডরা সেদিন আহত মানুষের ওপর বেয়নেট চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে পুলিশ আমাকে আহত অবস্থায় আটক করে ডিবি পাহাড়ে (বর্তমানে পুলিশ কমিশনার কার্যালয়) নিয়ে যায়। সেখানে চলে আরেক দফায় অমানবিক অত্যাচার। কিন্তু আমাকে চিনতে না পারায় সেদিন আমাকে ছেড়ে দেয়া হয়। লাশ গুম করার জন্য রাতের আঁধারে নগরের অভয়মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয় নিহতদের।’
এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শম্ভু নাথ নন্দী জাগো নিউজকে বলেন, ‘তখন আমি তরুণ আইনজীবী। লালদীঘিতে সমাবেশের আগে ১৫ দলীয় জোটনেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আইনজীবী সমিতির বৈঠকের কথা ছিল। একটি খোলা জিপে করে শেখ হাসিনা বিমানবন্দর থেকে আসছিলেন। তার সঙ্গে ট্রাকে ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন, তোফায়েল আহমেদ, আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবুসহ আরও অনেকে। যখন গুলি শুরু হলো শেখ হাসিনাকে নিয়ে তারা জিপের পাটাতনে শুয়ে পড়েন। পরে আইনজীবী ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, ইব্রাহীম হোসেন বাবুল ও অশোক দাশ শেখ হাসিনাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আইনজীবী ভবনের অডিটরিয়ামে নিয়ে আসেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই আমিসহ সাংবাদিক কামরুল ইসলাম ও আইনজীবী গোপাল সেনকে নিয়ে হোটেল ব্রিজ থেকে চা খেয়ে বেরিয়েছিলাম। এ সময় আমরা শুনতে পাই পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা ওয়্যারলেস ব্যবহার করে কোতোয়ালি থানার তৎকালীন পেট্রল ইন্সপেক্টর গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডলকে মিছিলের ওপর গুলি চালাতে নির্দেশ দিচ্ছেন।’