এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। হঠাৎ ক্রিকেটারদের বড়সড় ‘আল্টিমেটাম’, রীতিমত ধর্মঘটের দাবি! মাঠ ছেড়ে আন্দোলনের ডাক সাকিব, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর মত তারকাদের। ১১ দফা দাবি না মানলে সবরকম ক্রিকেটীয় কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকার ঘোষণা।
সবার একটাই প্রশ্ন, হঠাৎ কেন এত হার্ড লাইনে ক্রিকেটাররা? বোর্ড কর্তারা কেন আগে প্রতিকারের উদ্যোগ নেয়নি? ক্রিকেটারদের সাথে বসে কথা বলে এবং তাদের দাবি মানার পাশাপাশি শর্ত পূরণের চেষ্টা করলেই তো আর অবস্থা এতটা গুরুতর হতো না।
এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়েছিল বোর্ড শীর্ষকর্তাদের কাছে। তাদের সবার জবাব ও একটাই কথা, কই আমরা তো কিছুই জানতাম না। আমাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন দাবি দাওয়া পেশ করা হয়নি।
এদিকে জাতীয় তারকা ক্রিকেটার সহ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের জাতীয় পর্যায়ের এবং আন্তর্জাাতিক ক্রিকেটীয় কর্মকান্ডে অংশ না নেবার এ হুঁশিয়ারি দেখে ও শুনে অনেকের মনেই প্রশ্ন, ‘আচ্ছা বাংলাদেশের ক্রিকেটে কি এটাই প্রথম? ক্রিকেটাররা জাতীয় লিগ না খেলার পাশাপাশি ভারত সফরের প্রস্তুতি ক্যাম্পসহ সবরকম ক্রিকেটীয় কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার এই ঘোষণা ও আন্দোলন এবং ধর্মঘটের ঘোষণা কি এটাই প্রথম?
কেউ কেউ না জেনে এটাকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেটারসহ ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটারদের প্রথম ধর্মঘটে ডাক বলে অভিহিত করেছেন। তাদের জন্য বলা, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এটাই ক্রিকেটারদের প্রথম ধর্মঘটের ডাক নয়। এটাই প্রথম আন্দোলনও না। এর আগেও একবার ক্রিকেটাররা বড় ধরনের আন্দোলনে নেমেছিলেন।
সেটা ১৯৯৮ সালের একদম শেষ দিককার ঘটনা। ক্রিকেটীয় মৌসুম হিসেব কষলে ১৯৯৮-১৯৯৯। তার মানে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে হিসেব করলে, ঠিক ২০ বছর পর আবার ক্রিকেটারদের আন্দোলন, ধর্মঘট। লিগ খেলার দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান নেয়া। সেই সাথে জাতীয় পর্যায়ের দলের হয়ে না খেলে মাঠের বাইরে দর্শকের ভূমিকায় থেকেছিলেন সাকিব, তামিম, মুশফিক ও রিয়াদদের পূর্বসুরিরা। বিশ বছর পর এবার আরেক প্রজন্ম নিজেদের দাবিতে সোচ্চার।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এখনকার মত বিপিএল, বিসিএল ছিল না তখন। ক্রিকেটারদের আয়ের একমাত্র আসর ছিল ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট মানে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। এবার যেমন বেতনভাতা, পারিশ্রমিক বাড়ানোসহ ১১ দফা দাবিতে ধর্মঘটের ডাক, সেবার অবশ্য এত কিছু ছিল না।
একটাই দাবি ছিল, লিগ আয়োজন করতেই হবে। দল-বদলের তারিখ নিয়ে কোনরকম তালবাহানা চলবে না। দল-বদলের সূচি আর লিগ শুরুর দিন ঠিক করতে হবে। না হয় সব রকম ক্রিকেটীয় কর্মকান্ড থেকে ধর্মঘট। সেবার ঐ লিগ আয়োজন নিয়ে ছিল তালবাহানা। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের আয়োজক-ব্যবস্থাপক সংগঠন সিসিডিএম লিগ শুরুর দিনক্ষণ ঠিক করা নিয়ে ছিল নানা জটিলতা।
দল-বদলের দিনক্ষণই ঠিক হচ্ছিল না। লিগ হবে- এমন নিশ্চয়তাও মিলছিল না। বারবার দিন তারিখ বদল হচ্ছিল। এক পর্যায়ে ক্রিকেটাররা ধরেই নিয়েছিল যে সেবার আর প্রিমিয়ার লিগ হবে না। তাই লিগ আয়োজনে নিশ্চয়তা এবং দল-বদলের দিনক্ষণ ঘোষণার দাবিতে ক্রিকেটাররা আন্দোলনে নেমেছিলেন, রাস্তায় নেমেছিলেন।
তৎকালীন তারকা ক্রিকেটার আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, ফারুক আহমেদ, আতহার আলি খান, এনামুল হক মণি, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, খালেদ মাহমুদ সুজন, খালেদ মাসুদ পাইলট, সেলিম শাহেদ, নাইমুর রহমান দুর্জয়, মোহাম্মদ রফিক- প্রমুখ জাতীয় ও তারকা ক্রিকেটাররা লিগ খেলার দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পর্যন্ত করেছিলেন। তারা ব্যাট ও বল হাতে নিয়ে ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড হাতে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন।
সিসিডিএমের সে সময়ের সভাপতির পদত্যাগ চেয়ে এবং দল-বদলের দিন তারিখ ধার্য্য করা ও লিগ শুরুর আনুষ্ঠানিক দিনক্ষণ চূড়ান্ত করার দাবিতে সোচ্চার সে সময়ের জাতীয় ক্রিকেটাররা- শুধু প্রেসক্লাবের সামনে ব্যাট-বলের পাশাপাশি ব্যানার, প্ল্যাকার্ড আর ফেস্টুন হাতেই দাঁড়াননি, স্লোগানে আকাশ বাতাস কাঁপাননি। মাঠ থেকেও দূরে সরে গিয়েছিলেন।
এমসিসির বিপক্ষে ম্যাচ খেলেননি আকরাম-বুলবুলরা
নিজেদের দাবিতে সোচ্চার আকরাম, নান্নু, বুলবুল, আতহার, মণি, পাইলট, দুর্জয়, বাশার, সেলিম, সুজন, পাইলট, রফিক ও দুর্জয়রা জাতীয় দল থেকেও দূরে সরে গিয়েছিলেন। ঠিক সে সময় মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) এসেছিল বাংলাদেশ সফরে। তখন এমসিসির বিপক্ষে খেলার জন্য বালাদেশ ‘এ’ দল মনোনীত করতে গিয়ে চরম বিপাকে পড়ে গিয়েছিলেন তখনকার বোর্ড কর্তা তথা নির্বাচকরা।
একজন জাতীয় ক্রিকেটারও খেলেননি বা খেলতে রাজি হননি। তাদের ধর্মঘটের কারণে শেষ পর্যন্ত বিকল্প তথা একদম আনকোরা ক্রিকেটার নিয়ে দল সাজিয়ে এমসিসির বিপক্ষে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে স্থানীয় বিসিবি একাদশ নামধারী দল সাজানো হয়েছিল।
আকরাম, নান্নু, বুলবুল, আতহার, মণি, পাইলট, দুর্জয়, বাশার, সেলিম, সুজন, পাইলট, রফিক ও দুর্জয়সহ অর্ধ শতাধিক জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেটার ধর্মঘটে ডাক দিলে তাদের ছাড়া একদম আনকোরা ও অখ্যাত প্রথম বিভাগ ও দ্বিতীয় বিভাগের ক্রিকেটারদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল বিসিবি একাদশ নামধারী বাংলাদেশ এ দল।
তখনকার জাতীয় ক্রিকেটারদের সবাই ঐ ম্যাচ না খেলে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের তিন নম্বর গেটের ভিআইপি গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছিলেন। তাদের সেই না খেলে আন্দোলনরত চেহারার ছবি পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল।
বিশ বছর পর এবার আবার ক্রিকেটাররা নিজেদের দাবিতে সোচ্চার। তখন এমসিসির বিপক্ষে বিসিবি একাদশের হয়ে না খেলে রীতিমত রেকর্ড গড়েছিলেন বুলবুল-আকরামরা। অবশ্য পরে বোর্ড ও ক্রিকেটারদের মধ্যে আলাপ আলোচনায় মতৈক্যও হয়েছিল। লিগ শুরুর নিশ্চয়তা আর দল-বদলের সূচি ঘোষণার পর সে আন্দোলন থেকে সরে দাড়িয়েছিলেন ক্রিকেটাররা।
দেখা যাক এবার ক্রিকেটারদের ১১ দফা দাবি কিভাবে কত দ্রুত মেনে নেয় বিসিবি? দেশ ও জাতির বিশেষ করে ক্রিকেটের বৃহত্তর স্বার্থে এ আন্দোলন প্রশমন দরকার। ক্রিকেটাররা দেশের সম্পদ। তাদের দাবি যতটা সম্ভব দ্রুত মেনে নেয়া হবে ক্রিকেটের জন্যই ততো মঙ্গল।