যে কারণে ‘প্রায় বিলুপ্ত’ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট

লেখক:
প্রকাশ: ৫ years ago

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে বিরক্ত শরিক দলগুলো। বিশেষ করে ফ্রন্টের প্রধান শরিক বিএনপির প্রতি। দলগুলোর অধিকাংশ নেতার অভিযোগ, একাদশ সংসদ নির্বাচনে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে একটি জোট ও একজন ‘মুরুব্বি রাজনীতিবিদ’র ছায়া চেয়েছিল দলটি। বিএনপির ধারণা ছিল, নির্বাচনের সময় পুলিশ তাদের গণগ্রেফতার করবে। তাদের নামে মিথ্যা মামলা ও হামলা চালাবে।

বিএনপির ওপর একজন মুরুব্বির হাত থাকলে নির্বাচনের আগে এসব বিপত্তি সহজেই অতিক্রম করা যাবে। সেই রাজনীতিবিদের যদি প্রধানমন্ত্রী আর আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্যতা থাকে তাহলে তো কথাই নেই- এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের অভিমত, স্কাইপে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। তার পরামর্শেই ড. কামাল হোসেনকে মুরুব্বি হিসেবে নির্বাচিত করে তার নেতৃত্বে গঠন করা হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তাকে ঢাল হিসেবে নির্বাচনে গিয়েছিল বিএনপি। নির্বাচন শেষ, ড. কামাল শেষ, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও শেষ!

সরকারবিরোধী সর্ববৃহৎ এ জোট কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। জনবান্ধব কোনো ইস্যুতে নেই তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া, দীর্ঘদিন ধরে নেই কোনো কর্মসূচি। নিজেদের মধ্যেও নেই কোনো কথাবার্তা। নেতাদের নিজেদের মধ্যেও নেই কোনো যোগাযোগ।

বিএনপি বাদে ঐক্যফ্রন্টের অন্য শরিকরা বলছে, স্বার্থ হাসিল করতে না পেরে ঐক্যফ্রন্টকে পাত্তা দিচ্ছে না বিএনপি। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আগে লন্ডন থেকে তারেক রহমান তাদের ঐক্যফ্রন্ট গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ভোটে হেরে সেই তারেকের নির্দেশেই অকার্যকর হয়েছে ঐক্যফ্রন্ট।

তবে ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘কিছুসংখ্যক মহল অত্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। ঐক্যফ্রন্ট ঠিক আছে।’

২০১৮ সালের অক্টোবরে যখন সরকারবিরোধী এ জোট গঠিত হয়েছিল, অনেকেই রাজনীতির মাঠে একটি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখার জন্য উন্মুখ হয়েছিলেন। তবে তাদের সবাই এখন হতাশ।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাম্প্রতিক কার্যক্রম যাচাই করে দেখা যায়, ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পর তিনটি কর্মসূচি ডেকেছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল চলতি বছরের মার্চে। খালেদা জিয়ার মুক্তি, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও পুনর্নির্বাচনের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করার কথা ছিল তাদের। তবে মানববন্ধনের আগের দিন ‘প্রেস ক্লাবের সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির অজুহাতে’ তা বাতিল করা হয়। ৩১ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজনের ঘোষণা দিয়ে পরে ‘হল বরাদ্দ পাননি’ বলে সেটিও বাতিল করেন তারা। সর্বশেষ ২৪ এপ্রিল একটি কর্মসূচি দেন তারা। ধর্ষণের প্রতিবাদ করায় ফেনীর সোনাগাজীতে আগুন দিয়ে হত্যা করা নিহত শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি হত্যায় শাহবাগ চত্বরে গণজমায়েতের ডাক দেয় জোটটি। তবে একদিন আগে ‘অনিবার্য কারণবশত’ সেটিও বাতিল করা হয়।

২২ ফেব্রুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদ ‘নির্বাচনের অনিয়ম’ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে একটি গণশুনানি করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ঐক্যফ্রন্টের পরাজিত প্রার্থীরা এখানে নিজ নিজ এলাকায় অনিয়মের কথা বলেন। ওই গণশুনানির তথ্যগুলো একটি বই আকারে বের করে সেগুলো আদালতে জমা দেয়ার পরিকল্পনা ছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের। তবে ছয় মাস হলেও সেই বই আলোর মুখ দেখেনি।

জোটের নেতাদের সর্বশেষ বৈঠকটি হয়েছিল চলতি বছরের ১০ জুন। বৈঠক থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো সিদ্ধান্ত তো আসেইনি বরং এর এক মাস পর সংবাদ সম্মেলন করে জোট ছাড়েন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী।

ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার কারণ জানতে চাইলে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী বলেন, জাতীয় নির্বাচনের পর ঐক্যফ্রন্ট নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। তাদের আর কোনো দৃশ্যমান অস্তিত্ব নেই। তারা কোনো জাতীয় সমস্যার প্রতিও নজর দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই আমরা জোট থেকে বের হওয়ার ঘোষণা দিয়েছি।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এমন পরিস্থিতির কারণ হিসেবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐক্যফ্রন্টের এক শীর্ষ নেতা বলেন, বিএনপি শরিকদের মর্যাদা দেয়নি। নির্বাচনের আগে থেকেই তাদের ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। এর প্রথম কারণ ছিল আসন ভাগাভাগি। বিএনপি ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আগে যে কয়টি আসন দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিল তার অর্ধেকও দেয়নি। এছাড়া নির্বাচনের পর মূলত তারেক রহমান, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মোশাররফ হোসেন, মেজর হাফিজ উদ্দিন ঐক্যফ্রন্টকে সক্রিয় থাকতে দিচ্ছেন না।

তিনি বলেন, নির্বাচনের দিন তারাই প্রথম সিদ্ধান্ত নিল যে সংসদে যাবে না। গণফোরাম তাদের জ্যেষ্ঠ নেতা সুলতান মনসুরকে সংসদে যাওয়ার জন্য বহিষ্কার করল। অথচ বিএনপি নিজেই পরে সংসদে গেল।

জোটের আরেক নেতা বলেন, ঐক্যফ্রন্টের মূল শক্তি বিএনপি। বিএনপির কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সরকারের কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারছে না ঐক্যফ্রন্ট। বিএনপি তাদের কোনো সহযোগিতা করছে না।

ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক গণফোরামের এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করে জানান, বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই স্কাইপের মাধ্যমে রাজনীতি করছে, লন্ডনের রাজনীতি। তারেকের ইশারায় দুলছে। সেই তারেক রহমানই ঐক্যফ্রন্টের অলিখিত বিলুপ্তির মূল কারণ।

বিএনপির কারণে ঐক্যফ্রন্টের এমন পরিণতি- এমনটি আখ্যা দিয়ে জোটের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘যেকোনো জোটের কার্যক্রম পরিচালনা কিংবা আন্দোলনের উদ্যোগ নিতে হয় বড় দলকে। ঐক্যফ্রন্টের ক্ষেত্রেও তা-ই হওয়া উচিত ছিল। তবে বড় দল হয়তো চাচ্ছে না যে ঐক্যফ্রন্ট থাকুক। হয়তো তারা একাই চলতে চাচ্ছে, তাই এমন আচরণ করছে।’

ঐক্যফ্রন্ট ভাঙনের কারণ হিসেবে ক্ষুব্ধ নেতারা বলছেন, গণফোরাম ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে নামকাওয়াস্তে রাজনীতি করছেন। তাই বিরোধীরাও ঐক্যফ্রন্টে আস্থা হারাচ্ছেন।

তারা বলেন, প্রথমে নির্বাচনে পাস করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে জোট গঠন করেছিল বিএনপি ও ড. কামাল হোসেন। কিন্তু নির্বাচনে বড় হারের পর জোটের বিষয়ে নিরুৎসাহিত হয় বিএনপি। সংসদে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে টানাপোড়েনে জোটের দূরত্ব বেড়েছে। এছাড়া ঐক্যফ্রন্ট গঠনের ফলে বিএনপির পুরনো বন্ধু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ২০ দল ক্ষুব্ধ ছিল। তাদের মন রক্ষায় এখন আর ঐক্যফ্রন্টকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বিএনপি।

‘ঐক্যফ্রন্টের ভাঙনের কারণ বিএনপি’- এ বিষয়ে বিএনপির এক সিনিয়র নেতার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে ঐক্য তো দূরের কথা বিএনপির নিজেদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। সবার মধ্যে হতাশা। দলের অনেকে তারেক রহমানের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারছেন না। এছাড়া মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে রেখে বিএনপির জাতীয় সংসদে যাওয়ার ঘটনায় অনেক সিনিয়র নেতা ক্ষুব্ধ।’

বিএনপির ওই নেতা বলেন, বিএনপির ঘড়িতে লন্ডনের (যুক্তরাজ্য) সময় সেট করা। যেকোনো ইস্যুতে লন্ডন থেকে সিদ্ধান্ত আসার অপেক্ষায় থাকে তারা। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের মৃত্যুতে শোক জানানোর সিদ্ধান্তের জন্যও তারেক রহমানের ঘুম থেকে ওঠার অপেক্ষা করেছিল তারা। বিএনপি ধরেই নিয়েছে কোনো আন্দোলন করে পাঁচ বছরের আগে আওয়ামী লীগ সরকারকে সরানো যাবে না। এ কারণে তারা নিজেদের মধ্যে দল গোছাচ্ছে, জোট নিয়ে আগ্রহ নেই তাদের।

এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে পরাজিত করার জন্য আমরা ২০ দল ও ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছি। কিছু মহল অত্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা বলছে যে, বিএনপি যে মিটিং-টিটিং করছে ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য করছে। আমরা পরিষ্কার ঘোষণা দিতে চাই, ২০ দল ঠিক আছে, ঐক্যফ্রন্টও ঠিক আছে। আমরা ঐকবদ্ধভাবে এ সরকারকে পরাজিত করব, নেত্রীকে (বেগম খালেদা জিয়া) মুক্ত করব।’

ড. কামালে অনাস্থা

এদিকে ঐক্যফ্রন্টের কথিত বিলুপ্তির পেছনে জোটের আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের ওপর বিরক্ত নিজ দলের নেতারা। তারা বলছেন, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নেয়ায় এবং সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করায় ডুবেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। যদিও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের মন্তব্য, ‘ঐক্যফ্রন্ট ভাঙছে না, দলগুলোর সঙ্গে বসে ঐক্য আরও সুদৃঢ় করা হবে।’

তবে জোটের নেতাকর্মীদের মন্তব্য, ড. কামালের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না কেউ-ই। সাম্প্রতিককালে তার অদ্ভুত আচরণে ক্ষুব্ধ সবাই। জাতীয় সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে তিনি সুলতান মনসুরকে বহিষ্কার করেছিলেন। অথচ একই ‘অপরাধে’ মোকাব্বিরকে দলে রেখে পরবর্তীতে পদোন্নতি দিয়েছেন। ওই ঘটনায় দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসিন মন্টু নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন। তাকে এখন আর ঐক্যফ্রন্ট কিংবা গণফোরামের কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায় না।

এ বিষয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মিডিয়া সমন্বয়ক ও গণফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক লতিফুল বারী হামিম জাগো নিউজকে বলেন, জনগণ অবশ্যই বিরোধী দলগুলোর ঐক্য আশা করে। তাদের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ও রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখা উচিত। জনবিরোধী নানা সিদ্ধান্তে কর্মসূচি দিয়ে জনগণের পাশে থাকতে হবে। আমি মনে করি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য অটুট রেখে সবাইকে এক হতে হবে।