পালিত হলো পবিত্র হজ

লেখক:
প্রকাশ: ৫ years ago

পবিত্র মক্কা নগরীর অদূরে আরাফাতের উন্মুক্ত প্রান্তরে অবস্থান করে অশ্রুভেজা নয়নে মহান আল্লাহর কাছে গোটাজীবনের পাপমুক্তির প্রার্থনা ও আত্মশুদ্ধির অঙ্গীকারের মাধ্যমে শনিবার পবিত্র হজ পালন করেছেন সারাবিশ্ব থেকে আগত প্রায় ত্রিশ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান।

আরাফাতের পাহাড় ঘেরা ময়দান ছাপিয়ে আকাশ-বাতাস মুখর ও প্রকম্পিত হয়েছে আবেগাপ্লুত সম্মিলিত কণ্ঠের ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বা, লা-শারিকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নে’মাতা লাকা ওয়াল মুলক লাশারিকা লাক’-তালবিয়ায়। এক অপার্থিব আবহ রচিত হয় পুরো ময়দানে। সবার পরনে কাফনের কাপড়ের মতো সাদা দুই খণ্ড বস্ত্র। সবারই দীন-হীন বেশ।

দুপুরে সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর আরাফাতের ময়দান সংলগ্ন মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুতবা দেওয়া শুরু করেন সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ এবং গবেষণা-মুফতি বোর্ডের সদস্য শায়খ মুহাম্মদ বিন হাসান আলে আশ-শায়খ।

পবিত্র হজের খুতবায় মুসলিম উম্মাহর শান্তি, ঐক্য ও সমৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন খতিব। দীর্ঘ লিখিত খুতবায় তিনি সঠিক ইসলামের পথে মুসলিমদের ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়াও করেছেন। বলেছেন, আল্লাহর রজ্জু আঁকড়ে ধরাই মুক্তির একমাত্র পথ। নতুন এই খতিব হারামাইন শরিফাইনের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার আহ্বান জানিয়ে সৌদি রাজপরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজসহ রাজপরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া করেছেন। খুতবায় মুহাম্মদ বিন সালমানের কথাও উল্লেখ করেন। তার দীর্ঘ হায়াত ও কল্যাণের জন্যও দোয়া করা হয়।

হজের খুতবায় মুসলমানদের আমল পরিশুদ্ধ করার প্রতি বিশেষ জোর দেয়া হয়। পারস্পরিক আচরণ, লেনদেন পরিশুদ্ধ করার তাগিদ দেয়া হয়। আমলের ত্রুটির কারণে মুসলিমরা দুর্যোগের শিকার হবে এমন সতর্কতাও দেয়া হয়। সৃষ্টির প্রতি দয়া ও সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সৃষ্টির প্রতি দয়ার্দ্র হলে আল্লাহ তার প্রতি দয়াশীল হবে বলে হাদিসের বাণী উদ্ধৃত করেন। ধৈর্য ধারণের কথা বলা হয়। এক মুমিন আরেক মুমিনের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার তাগিদ দিয়ে বলা হয়, এর দ্বারা আল্লাহর রহমত অর্জিত হবে। মুসলমানদের জাকাত আদায়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়। আল্লাহর রাস্তায় খরচ করতে বলা হয়। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হতেও আহ্বান জানানো হয়।

খুতবায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহে ওয়া সাল্লামের একটি হাদিস পড়েন, যার মূলকথা হলো- কোনো মুসলমানের যদি সক্ষমতা অর্জন হয়, তাহলে জীবনে একবার হলেও তাকে অবশ্যই হজ করতে হবে।

শায়খ মুহাম্মদ বিন হাসান বলেন, তাওহিদ ও খতমে নবুওয়তের সাক্ষী ইসলামের মৌলিক রোকন। এছাড়াও নামাজ ও জাকাত ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। জাকাতের মাধ্যমে গরিব অসহায়দের ব্যাপক কল্যাণ সাধিত হয়।

তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালার হুকুম কখনও পরিবর্তন হয় না। আল্লাহ তায়ালা মানুষ এবং জীন জাতিকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এ জন্য তাওহিদ ও আল্লাহর একত্ববাদের বিষয়টি আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।

মুসলিম উম্মাহর মুক্তির উপায় উল্লেখ করে শায়খ মুহাম্মদ বিন হাসান বলেন, পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালার রহমতের কথা বারবার বলা হয়েছে। আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরাই মুক্তির একমাত্র উপায়। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। খুতবার শেষ দিকে হজের আহকাম জানিয়ে দেন খতিব। মুসলমানদের ঐক্য ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করেন।

খুতবা সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও বিশ্বের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করে। অনেক হজ এজেন্সি নিজ উদ্যোগে আরাফার ময়দানে উপস্থিত হাজীদেরকে খুতবার অনুবাদ শোনানোর ব্যবস্থা নিয়েছেন।

হজের খুতবা সমাপ্ত হবার পর ইমামের পেছনে পরপর জোহর ও আসরের নামাজ জোহরের ওয়াক্তে আদায়ের পর সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করেন হাজিরা।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মেহমানরা শনিবার সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে কেউ গাড়িতে, কেউ পায়ে হেঁটে আরাফাতের ময়দানের দিকে রওনা হন। আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা হজের অন্যতম ‘ফরজ’ বা অবশ্য পালনীয়। মূলত ৯ জিলহজ আরাফাতে অবস্থান করার দিনকেই হজের দিন বলা হয়। জনশ্রুতি আছে যে, হযরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) দীর্ঘদিন কান্নাকাটির পর এখানেই এসে মিলিত হয়েছিলেন। হাজিরা আরাফাত ময়দানে অবস্থান শেষে তাদের গন্তব্য মুযদালিফা। সেখানে গিয়ে মাগরিব ও এশা’র নামাজ এশা’র ওয়াক্তে একত্রে পড়বেন এবং সমস্ত রাত অবস্থান করবেন।

মিনায় জামরাতে নিক্ষেপ করার জন্য ৭০টি কংকর এখান থেকে সংগ্রহ করবেন। মুযদালিফায় ফজরের নামাজ পড়ে মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। ১০ জিলহজ মিনায় পৌঁছার পর হাজিদের পর্যায়ক্রমে চারটি কাজ সম্পন্ন করতে হয়। প্রথমে মিনাকে ডান দিকে রেখে হাজিরা দাঁড়িয়ে শয়তানকে (জামারা) পাথর নিক্ষেপ করবেন। দ্বিতীয় কাজ আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করা। অনেকেই মিনায় না পারলে মক্কায় ফিরে গিয়ে পশু কোরবানি দেন। তৃতীয় পর্বে মাথা ন্যাড়া করা। চতুর্থ কাজ তাওয়াফে জিয়ারত। হাজিরা মক্কায় ফিরে কাবা শরীফ ‘তাওয়াফ’ ও ‘সাঈ’ (কাবার চারদিকে সাতবার ঘোরা ও সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌঁড়ানো) করে আবার মিনায় ফিরে যাবেন। জিলহজের ১১ তারিখ মিনায় রাত যাপন করে দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হাজিরা বড়, মধ্যম ও ছোট শয়তানের উপর সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করবেন। আর এ কাজটি করা সুন্নত। পরদিন ১২ জিলহজ মিনায় অবস্থান করে পুনরায় একইভাবে হাজিরা তিনটি শয়তানের উপর পাথর নিক্ষেপ করবেন। শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা শেষ হলে অনেকে সূর্যাস্তের আগেই মিনা ছেড়ে মক্কায় চলে যান। আর মক্কায় পৌঁছার পর হাজিদের একটি কাজ অবশিষ্ট থাকে। সেটি হচ্ছে কাবা শরীফ তাওয়াফ করা। একে বলে বিদায়ী তাওয়াফ। স্থানীয়রা ছাড়া বিদায়ী তাওয়াফ অর্থাত্ কাবা শরীফে পুনরায় সাতবার চক্কর দেয়ার মাধ্যমে হাজিরা সম্পন্ন করবেন পবিত্র হজব্রত পালন।