জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আর নেই। আজ (রোববার) সকাল পৌনে ৮টার দিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) পরিচালক আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, সকাল ৭টা ৪৫ থেকে ৮টার মধ্যে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুও সাবেক রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এর আগে শনিবার এরশাদের ছোট ভাই ও সাবেক মন্ত্রী জি এম কাদের জানিয়েছিলেন, ওনার লিভার যেটা কাজ করছিল না, এখনো সেই অবস্থায় আছে। ওনাকে শিরার মাধ্যমে শরীরে পুষ্টি দেওয়া হচ্ছে এখনো পর্যন্ত। ব্লাডে ওনার যে সমস্যা এবং সার্বিকভাবে ওনার যে বয়স হয়ে গেছে -এ দুটোর কারণে ডাক্তাররা মনে করছেন, রিকভারি যত দ্রুত হওয়ার কথা ছিল বা অন্যান্য ক্ষেত্রে যা হয় তার ক্ষেত্রে সেভাবে রিকভারি হচ্ছে না, অনেকটা স্লো।
৯০ বছর বয়সী এরশাদ রক্তে সংক্রমণসহ লিভার জটিলতায় ভুগছিলেন। গত ২২ জুন সিএমএইচে ভর্তি করা হয় তাকে। এর আগেও তিনি একাধিকবার দেশ-বিদেশে চিকিৎসা নেন।
রংপুর-৩ আসন থেকে বারবার নির্বাচিত এ সংসদ সদস্যের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। তিনি রংপুর জেলার দিনহাটায় জন্মগ্রহণ করেন। এরশাদ বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান, এককালীন প্রধান সামরিক প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৯০ সালে ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জেলও খাটতে হয় তাকে।
১৯৮১ সালে ৩০ মে, জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর এরশাদের রাজনৈতিক অভিলাষ প্রকাশ পায়। ১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর নাগাদ তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন শুরু করেন। ওইদিন তিনি দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এএফএম আহসানুদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে নিজের অধিকারে নেন।
এরশাদ দেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু করেন এবং ১৯৮৫ সালে প্রথম উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এ দলের মনোনয়ন নিয়ে ১৯৮৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দিনটিকে আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’, বিএনপি ‘গণতন্ত্র দিবস’ এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি ‘সংবিধান সংরক্ষণ দিবস’ হিসেবে পালন করে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল দিনটিকে ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ হিসেবেও পালন করে থাকে।
রাজনীতিতে বহুল বিতর্কিত এ ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেননি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় এরশাদ ছুটিতে রংপুর ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে পাকিস্তান চলে যান। পাকিস্তান থেকে আটকে পড়া বাঙালিরা যখন ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরে আসেন তখন তিনিও প্রত্যাবর্তন করেন।
এরশাদ ও তার দল জাতীয় পার্টি বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রীতিমতো হাস্যরসের বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। একেক সময় একেক ধরনের সিদ্ধান্ত এবং নির্বাচনের আগ মুহূর্তে ‘অসুস্থ বোধ’ রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।
১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি কারাগার থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ওই নির্বাচনে রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন তিনি। বিএনপি সরকার তার বিরুদ্ধে কয়েকটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। তার মধ্যে কয়েকটিতে তিনি দোষীসাব্যস্ত হন এবং সাজাপ্রাপ্ত হন।
১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। ছয় বছর আবরুদ্ধ থাকার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্তি পান। তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি ২০০০ সালে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার মধ্যে মূল ধারার চেয়ারম্যান হন তিনি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় পার্টি। তার স্ত্রী রওশন এরশাদ প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা হন।
গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের পর টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে মনোনীত হন। জোটগতভাবে নির্বাচন করে ২২টি আসনে জয়ী হয় জাতীয় পার্টি।