দুই বছর স্থগিত থাকার পর বহুল আলোচিত নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ আইন কার্যকরের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
আইনে ভ্যাটের আওতা ব্যাপক বাড়ানো হয়েছে। এতে ভ্যাটের চারটি হার (রেট) নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো- ৫, সাড়ে ৭, ১০ ও ১৫ শতাংশ। এর বাইরে নির্মাণ সামগ্রীর অন্যতম উপকরণ রডসহ কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কর নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়।
এ ছাড়া পেট্রোলিয়াম ও ওষুধের ভ্যাটহার আগের মতোই বহাল রাখা হয়েছে। ভ্যাটের আদর্শ রেট বর্তমানের ১৫ শতাংশ হার নির্ধারণ করা হয়। যারা এ হারে ভ্যাট দেবে, তাদের রেয়াত সুবিধা দেওয়া হবে। ১৫ শতংশের নিচের স্তরে এ সুবিধা থাকবে না। এ ছাড়া নতুন আইনে বিতর্কিত ও ত্রুটিপূর্ণ পণ্যের ট্যারিফ ভ্যালু প্রথা এবং সেবা খাতের সংকুচিত মূল্য ভিত্তি পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। এর পরিবর্তে বাজারমূল্যে সহনীয় হারে ভ্যাট আদায়ের প্রস্তাব করা হয়। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভ্যাট আদায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্যাকেজ ভ্যাট প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।
নতুন আইনে প্রতি টন রডে নির্ধারিত ট্যারিফ ধরা হয়েছে দুই হাজার টাকা, যা আগে গ্রেড ভেদে টনপ্রতি ৫৪০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা ভ্যাট দিতে হতো। ফলে নতুন আইন কার্যকর হলে রডের দাম বাড়বে। এতে করে নির্মাণ শিল্পের খরচ বাড়বে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলেছে, নতুন আইনের কিছু অংশ বাজেট ঘোষণার দিন থেকে কার্যকর হয়েছে। কিছু অংশ ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। এ ছাড়া নতুন ভ্যাট আইন বর্তমান ১৯৯১ সালের আদলে সংশোধন করা হয়। এতে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন আইনে ভ্যাটের জাল আরও বিস্তৃত হবে। এতে ভ্যাটের যে হার নির্ধারণ করা হয়ছে, তা কার্যকর হলে পণ্য উৎপাদন ও সেবার খরচ বাড়বে, যা প্রকারান্তরে ভোক্তা তথা জনগণের ওপর করের বোঝা চাপবে। অবশ্য এর বিপরীত কথা বলেছেন এনবিআরের সদস্য (ভ্যাট-নীতি) ড. আব্দুল মান্নান সিকদার। তিনি সমকালকে বলেন, প্রস্তাবিত নতুন ভ্যাট আইন ব্যবসা ও ভোক্তাবান্ধব। এতে ভোক্তার ওপর করের চাপ আসবে না।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে ২০১০ সালে নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন করা হয়, যা ২০১২ সালে সংসদে পাস হয়। এরপর কয়েক দফা উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। গত দুই অর্থবছরে আইনটি চূড়ান্ত করে বাজেটে ঘোষণা দেওয়া হয় কার্যকরের জন্য। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে অভিন্ন বা ১৫ শতাংশ রেট নিয়ে তীব্র আপত্তি করে এফবিসিসিআইসহ ব্যবসায়ীরা। ফলে সংসদে বাজেট পাসের দিন আইনটি দুই বছরের জন্য স্থগিত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমাঝোতার ভিত্তিতে একক রেটের পরিবর্তে একাধিক রেট নির্ধারণ করে ফের সংশোধন করা হয়, যা সংসদে কার্যকরের ঘোষণা দেওয়া হয় গতকালের বাজেট বক্তৃতায়।
নতুন আইনে ভ্যাটের অব্যাহতি সীমা ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগে ছিল ৩০ লাখ টাকা। করমুক্ত সীমা বাড়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ভ্যাটের আওতা থেকে মুক্তি পাবেন। তবে ৫০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত ৪ শতাংশ হারে (টার্নওভার) কর দিতে হবে। এ ছাড়া নতুন আইনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নতুন আইনে উৎসে কর কর্তনের পরিধি ব্যাপক বাড়ানো হচ্ছে। এখন শুধু আমদানি পর্যায়ে বাণিজ্যিক পণ্যে ‘অগ্রিম’ ভ্যাট (এটিভি) আদায় করা হয়। নতুন আইনে বাণিজ্যিকসহ সব পণ্যে অগ্রিম ভ্যাট দিতে হবে। তবে এনবিআর বলেছে, যারা আগাম ভ্যাট দেবে পরবর্তী সময়ে তাদের ওই ভ্যাট ফেরত দেওয়া হবে। এতে কর-ভার কমবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন আইনে যে রেট নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে দেখা যায় মোট কর-ভার পণ্য ও সেবার মূল্যে গড়ে ২৭ থেকে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। এ হার বর্তমানে আছে ২০ শতাংশ। যোগাযোগ করা হলে ভ্যাট বিশেষজ্ঞ আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও বেসরকারি সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, যারা ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দেবেন, শুধু তারাই রেয়াত পাবেন। তারা সাধারণত বড় ব্যবসায়ীশ্রেণি। ফলে তারা প্রকৃত ভ্যাট সিস্টেমে থাকবেন। অন্যদিকে ১৫ শতাংশের নিচে অথার্ৎ ৫, সাড়ে ৭ ও ১০ শতাংশ হারে যারা ভ্যাট দেবেন তারা রেয়াত সুবিধা পাবেন না।
আহসান মনসুরের মতে, এ পদ্ধতি প্রকারান্তরে আবগারি প্রথা চালু করার শামিল, যা ভ্যাট আইনের পরিপন্থি। তিনি বলেন, এক পক্ষ রেয়াত পাবে, আর অন্য পক্ষ পাবে না। একই আইনে দুই পদ্ধতি চালু করা হলে ট্যাপ অন ট্যাপ (দ্বৈত কর) আরোপ করা হবে। তখন পণ্য ও সেবার খরচ বাড়বে, যা ভোক্তার ঘাড়ে এসে পড়বে।
এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, নতুন আইনের নামে আসলে বর্তমান আইনটি বহাল রাখা হলো। এতে বিভিন্ন স্তরে রেয়াত সুবিধা না থাকায় পণ্য ও সেবার খরচ বাড়বে। ভ্যাট আদায়ে জটিলতা তৈরি হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভোক্তা।