কেউ তাকে ডাকতেন ‘বইওয়ালা দাদুভাই’ । কেউ আবার ‘আলোর ফেরিওয়ালা’। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা বাউসা থেকেই ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন পলান সরকার। আলোকিত হয়ে উঠেছে আশেপাশের অন্তত ২০ গ্রাম।
সেই পলান সরকার আর নেই। শুক্রবার দুপুরে নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ ছিলেন পলান সরকার। ছয় ছেলে ও তিন মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন তিনি।
বাউসা বাজার গেদুর মোড়ে পলান সরকারের বাড়ি। বাড়ির পাশেই গড়ে তুলেছেন পাঠাগার। এখন সেখান থেকে ছড়িয়ে যায় জ্ঞানের আলো।
১৯২১ সালের ১ আগস্ট নাটোর জেলার বাগাতিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন পলান সরকার। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন হারেজ উদ্দিন সরকার। তবে মা ‘পলান’ নামে ডাকতেন। পাঁচ বছর বয়সে বাবা হায়াত উল্লাহ সরকারকে হারান পলান।
এরপর আর্থিক সঙ্কটে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় চতুর্থ শ্রেণিতেই। পরে নানা ময়েন উদ্দিন সরকার মা মইফুন নেসাসহ পলান সরকারকে নিয়ে আসেন নিজ বাড়ি বাউসায়।
সেখানকার স্কুলে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণির পর ইতি টানেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার। তবে থেকেই যায় বই পড়ার অভ্যাস। প্রথমে এর ওর কাছ থেকে বই ধার করে এনে পড়তেন। যখন যে বই পেয়েছেন সাগ্রহে পড়েছেন।
পলান সরকার বড় হন নানা বাড়িতে। নানা ময়েজ উদ্দিন সরকার ছিলেন স্থানীয় ছোট জমিদার। যৌবনে তিনি নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন। দেশ বিভাগের পর জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হলে বাউসা ইউনিয়নে কর আদায়কারির চাকরি পান। নানার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ৪০ বিঘা সম্পত্তিরও মালিক হন।
ব্রিটিশ আমলেই তিনি যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন। অভিনয় করতেন ভাঁড়ের চরিত্রে। হাসাতেন লোক। আবার যাত্রার পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে কপি করতেন। মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপও বলে দিতেন। এভাবেই বই পড়ার নেশা জেগে ওঠে তার।
১৯৬৫ সালে ৫২ শতাংশ জমি দান করে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন পলান সরকার। ১৯৯০ সাল থেকে ওই বিদ্যালয়ে মেধাতালিকায় প্রথম দশটি স্থান অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের বই উপহার দিতেন তিনি।
এরপর অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও বইয়ের আবদার করলে সিদ্ধান্ত নেন তাদেরও বই দেবেন। শর্ত দেন পড়ার পর তা ফেরত দেয়ার। এরপর গ্রামের মানুষও তার কাছে বই চাইতে শুরু করেন। ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে বই পড়া আন্দোলন।
১৯৯২ সালে ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত হন পলান সরকার। ওই সময় তিনি হাঁটার অভ্যাস করেন। এ থেকেই বিদ্যালয় কেন্দ্রিক বই বিতরণ প্রথা ভেঙে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেয়া শুরু করেন। পথে পথে ঘুরতে শুরু করেন ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার হয়ে।
পড়তে দেয়ার জন্য বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদি লেখকদের বইগুলো রয়েছে পলান সরকারের সবচেয়ে পছন্দের তালিকায়। তাছাড়া লোকসাহিত্যসহ অন্যান্য জনপ্রিয় লেখকের বইও তিনি বিতরণ করেন।
এভাবেই চা দোকানি থেকে শুরু করে গৃহবধূ সবাই তার পাঠকের তালিকায় চলে আসেন। বদলে যায় দৃশ্যপট। নিজের গ্রামে তার বাড়িটিই হয়ে ওঠে পাঠাগার। তবে ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তার বাড়ির আঙিনায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে দেয়। দান-অনুদানে মিলে যায় বইসহ অন্যান্য আসবাব।
প্রথমে আশপাশের দশ গ্রামের মানুষই কেবল জানতেন পলান সরকারের কীর্তি। কিন্তু ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ তাকে তুলে আনে আলোকিত মানুষ হিসেবে। এরপর তিনি ২০১১ সালে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন।
২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার উপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হয় নাটক, বিজ্ঞাপন চিত্র। শিক্ষা বিস্তারের অন্যন্য আন্দোলন গড়ে তোলায় ইউনিলিভার বাংলাদেশ পলান সরকারকে সাদা মনের মানুষ খেতাবে ভূষিত করে।