ইসলামী বইয়ের দুনিয়ায়…

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোরআন শরীফটি রয়েছে আফগানিস্তানে। তবে বাংলাদেশের হাতে লেখা কোরআন শরীফটিও কম বড় নয়। এক সময় এটিকে এশিয়ার সবচেয়ে বড় কোরআন শরীফ হিসেবে ধরা হতো। ৬১ কেজি ওজনের হাতে লেখা বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ কোরআনটি আট বছরে (১৯৮১-৮৯) লিখেছিলেন রাজশাহীর গোদাগাড়ি থানার বামনাহাল গ্রামের মোহাম্মদ হামিদুজ্জামান। ১১শ পৃষ্ঠার এ কোরআন শরীফটির দৈর্ঘ্য ২ ফুট ৫ ইঞ্চি ও প্রস্থ ১ ফুট ১১ ইঞ্চি। উচ্চতা ৯ ইঞ্চি। কিন্তু দেশের অনেকেই জানেন না কোথায় এটি সংরক্ষিত রয়েছে! ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরির প্রদর্শনী কক্ষে এমনি আরো বেশকিছু আকর্ষণীয় সংগ্রহ অযত্নে অবহেলায় পড়ে রয়েছে।
শুধু সংগ্রহশালাই নয়; এ লাইব্রেরিতে ইসলাম বিষয়ক প্রায় সোয়া লাখ বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির পর এটিই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম লাইব্রেরি। এখানে স্থান পাওয়া বইয়ের মধ্যে রয়েছে কোরআন শরীফ ও হাদিসের ব্যাখ্যা, ইতিহাস, মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের জীবনী ও তাদের আবিষ্কার। শুধু বাংলা নয়, ইসলাম নিয়ে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে এই লাইব্রেরিতে। এ ছাড়া, আরবি, উর্দু, ফারসি ভাষায় লেখা বইয়ের সংগ্রহও বিশাল এ লাইব্রেরির।ইসলামিক ফাউন্ডেশন ইসলামের আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রচার এবং ইসলামী কর্মকাণ্ড পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৯ সালে ঢাকায় একটি বৃহত্ মসজিদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ‘বায়তুল মোকাররম সোসাইটি’ নামে একটি সমিতি গঠন করা হয়। একই বছর ঢাকার কয়েকজন ইসলামী চিন্তাবিদ তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামী জীবনাদর্শের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গবেষণা এবং ইসলামী সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে ‘দারুল উলুম’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরের বছর ‘ইসলামিক একাডেমী’ নামে এর নতুন নামকরণ করে করাচিতে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের শাখারূপে একে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ বায়তুল মোকাররম সোসাইটি এবং ইসলামিক একাডেমী একীভূত করে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি আধুনিক ইসলামী গ্রন্থাগার স্থাপন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য। এ পর্যন্ত লক্ষাধিক দেশি-বিদেশি গ্রন্থ এখানে সংগৃহীত হয়েছে এবং নতুন সংগ্রহের কাজও চলছে নিয়মিতভাবে। দেশি-বিদেশি অনেক সাময়িকীও এ সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার পর ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর গবেষণাসহ ইসলামী জ্ঞান বিকাশের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন লাইব্রেরির কার্যক্রম শুরু হয়। ইসলামের প্রসার ও প্রচারের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক শামীম মোঃ আফজাল বলেন, ধর্ম বিষয়ক পড়াশোনার আগ্রহ মানুষের মাঝে কম। পড়াশোনা নেই বলেই ধর্মের অপব্যাখ্যায় প্রভাবিত হয়ে পড়ে মানুষ। অনেকে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কিশোর-তরুণদের বিপথে পরিচালিত করছে। ইসলাম শান্তির ধর্ম। মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়। সেখানে হানাহানির স্থান নেই। আমাদের সকল কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ইসলামের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরবার চেষ্টা।
সংগ্রহশালা ঘুরে …
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে প্রবেশের পূর্ব দিকের সিঁড়ির পাশেই এ লাইব্রেরি। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে লাইব্রেরির সংগ্রহশালা। সংগ্রহশালায় প্রবেশের মুখেই কাঁচঘেরা হাতে লেখা বিশাল কোরআন শরীফটি চোখে পড়ে। এরপরেই টেবিলে নানা দেশের নানা ভাষার সুদৃশ্য সব কোরআন শরীফ।
সংগ্রহশালায় আরো রয়েছে দুই দশমিক ৩৮ গ্রাম ওজনের ক্ষুদ্র এক কপি মুদ্রিত কোরআন শরীফ। রয়েছে চট্টগ্রামের মফিজুল হক নূরী লিখিত কোরআনের ছায়ালিপি, অন্ধদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতিতে কোরআন শরীফ, বার্মিজ, তাজিকি, অহমীয়া, লেবানিজ এবং ইন্দোনেশিয়ান ভাষার কোরআন শরীফ। দিল্লির নিজামউদ্দীন আউলিয়ার দরবার শরীফ থেকে পাঠানো হাতে লেখা দুষ্প্রাপ্য কোরআন শরীফ সংরক্ষিত রয়েছে এখানে। এসবের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ভিড় জমে থাকে কাবা শরীফের গিলাফ-এর অংশটিকে ঘিরে। এ প্রদর্শনী কক্ষে আরো রয়েছে মহান আল্লাহ তায়ালার ৯৯টি গুণবাচক (আসমাউল হুসনা) নামসমূহের ৩৫টি পোস্টার ও হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনীমূলক (বংশ পরিচয় থেকে শুরু করে ওফাতসহ) ১৩টি পোস্টারসহ সর্বমোট ৪৮টি পোস্টার।
পুরো সংগ্রহশালাটিতেই অযত্নের ছাপ। প্রতিটি বইয়ে ধুলোর স্তর জমেছে। বইগুলো খোলা রাখা হয়েছে টেবিলের ওপরে। দর্শণার্থীরা যে কেউ এসে সেসব বই নিয়ে টানাটানি করছেন। অনেক বইয়ের ভেতরের পাতা ছিঁড়ে গেছে। কিন্তু সেসব সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। নষ্ট হয়ে যাবে বলে ইতোমধ্যেই এ সংগ্রহশালা থেকে হযরত উসমান (রা.) এর সময়ের হাতে লেখা পবিত্র কোরআন শরীফ ‘মাসহাফে উসমানী’র ছায়ালিপি জাতীয় জাদুঘরকে দিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহকারী লাইব্রেরিয়ান মোঃ শহীদুল ইসলাম জানান, সংগ্রহশালাটি আরো ভালোভাবে উপস্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পেলে তা ঢেলে সাজানো হবে।
ইসলামী বইয়ের দুনিয়ায় …
লাইব্রেরিতে ইসলামিক বইয়ের সংগ্রহ বিশাল। তা ছাড়া পাঠকদের জন্য এ লাইব্রেরি উন্মুক্ত। তবে এ লাইব্রেরি কার্যক্রমের বিশালতা অন্য জায়গায়। দেশজুড়ে প্রতিটি বিভাগীয় ও জেলা শহরে এই লাইব্রেরির শাখা রয়েছে। সেসব জায়গাতেও রয়েছে বইয়ের সংগ্রহ। এত বিশাল সংগ্রহের লাইব্রেরির তুলনায় পাঠকের সংখ্যা বেশ নগণ্য।
এ প্রসঙ্গে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক শামীম মোঃ আফজাল বলেন, ভারতবর্ষে ইসলামী শিক্ষাটি ছিল উর্দু ও ফারসি ও ইংরেজিনির্ভর। ধর্ম নিয়ে উচ্চশিক্ষার আগ্রহ কম। আমরা আমাদের কার্যক্রমে মানুষের মাঝে সেই আগ্রহ সৃষ্টির চেষ্টা করে চলেছি। সেইজন্য ফাউন্ডেশন বাংলায় বই প্রকাশ করে তা সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ফাউন্ডেশন ‘ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকল্পে’র অধীনে ২৭ খণ্ডে বৃহত্তর ইসলামী বিশ্বকোষ, সীরাত বিশ্বকোষ নামে ২২ খণ্ডে আরেকটি বিশ্বকোষ প্রকাশও প্রকাশ করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। প্রকাশনা বিভাগ থেকে ইসলামী মৌলতত্ত্ব, ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং জাতির শ্রেষ্ঠ মনীষীদের জীবনী বিষয়ক দু’হাজারের বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে গবেষণাধর্মী ত্রৈমাসিক পত্রিকা, মাসিক সাহিত্য পত্রিকা, মাসিক শিশু-কিশোর পত্রিকা এবং আল-ইমামত নামে একটি সাময়িকী নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
কোরআন শরীফের ব্যাখ্যা ও অনুবাদসহ বিভিন্ন ভাষায় ছাপা পবিত্র কোরআন শরীফ, তাফসীর গ্রন্থ, হাদীস গ্রন্থ, ইসলামী সাহিত্য, চিকিত্সা বিজ্ঞান, ইসলাম ও বিজ্ঞান, ইসলামী অর্থনীতি, ইসলামী দর্শন, ইসলামের ইতিহাস, ইসলামী আইন, বিভিন্ন ভাষায় অভিধান ও বিশ্বকোষ এবং সাহিত্যসমূহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার গ্রন্থ ও পুস্তিকা রয়েছে। এ লাইব্রেরিটি বর্তমানে বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ ইসলামিক পাবলিক লাইব্রেরি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
পুস্তক বিক্রয় কেন্দ্র …
ফাউন্ডেশনের নিজস্ব প্রকাশনাও খুব কম নয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার বই প্রকাশ করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। বায়তুল মোকাররম সংলগ্ন প্রধান বিক্রয় কেন্দ্রে রয়েছে সেসব বইয়ের সংগ্রহ। এখানে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ কমিশনের বই বিক্রি করা হয়। এ বিক্রয়কেন্দ্রের বিক্রয় সহকারী আব্দুল হক জানালেন, পবিত্র কোরআনের বঙ্গানুবাদ, তাফসীর গ্রন্থ, সিহাহ সিত্তাহসহ হাদীস গ্রন্থের অনুবাদ, মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর জীবনী, ইসলামী বিশ্বকোষ, সীরাত বিশ্বকোষ, আল-কুরআন বিশ্বকোষ, ইসলামী আইন ও ফিক্হ, স্থাপত্যকলা প্রভৃতি বইয়ের চাহিদা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- জঙ্গিবাদের উত্স মওদুদীপন্থীদের ভ্রান্ত শিক্ষা রাজনীতি ও ব্যাংকিং ব্যবসা, ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনূদিত আল-কুরআনুল করীম, তফসীরে মা’আরেফুল কোরআন, তাফসীরে ইবনে কাছীর, আহকামুল কুরআন, সাফওয়াতুত তাফাসির, বুখারী  শরীফ, তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ, হাদীসে কুদসী, মুয়াত্তা ইমাম মালিক (র), সীরাতুন নবী (সা.), শামায়িলুন নবী (সা.), মি’রাজুল মু’মিনীন, ফাতাওয়া ও মাসাইল, ইসলামী আইন ও আইন বিজ্ঞান, মুসলিম মনীষা, শিক্ষা দর্শন ও ইসলাম প্রভৃতি। এছাড়া শিশুদের জন্যও বিশেষ প্রকাশনা রয়েছে ফাউন্ডেশনের।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোরআন শরীফ
আফগানিস্তানের হস্তলিপিকার মোহাম্মদ সাবির খেদ্রি ৫০০ কেজি ওজনের একটি কোরআন হাতে লিখে তৈরি করেছেন যা বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম কোরআন শরীফ। ৫ লাখ ডলার খরচ করে তৈরি করা এ কোরআন শরীফটিতে ২১৮টি পৃষ্ঠা রয়েছে যেগুলো কাপড় ও কাগজের তৈরি এবং পৃষ্ঠাগুলোর আকার দৈর্ঘ্যে ৯০ ইঞ্চি প্রস্থে ৬১ ইঞ্চি। পৃষ্ঠার প্রান্তগুলো চামড়া দিয়ে কারুকার্যমন্ডিত যা তৈরি করতে ২১টি ছাগলের চামড়া ব্যবহার করা হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই কোরআনের উচ্চতা ৭ ফুট এবং প্রস্থ প্রায় ১০ ফুট। এতে মোট পৃষ্ঠার সংখ্যা রয়েছে ২১৮।
২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোরআন শরীফ লেখার কাজ শুরু করেন এবং ২০০৯ সালে শেষ করেন। এর ৩০ পারায় ৩০টি ভিন্ন ধরনের ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার করেছেন তারা। কাবুল কালচারাল সেন্টার জানিয়েছে, এই কোরআনটিকে পৃথিবীর বৃহত্তম বলে ঘোষণা দিয়েছে আফগানিস্তানের হজ ও ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কোরআন শরীফটি এখন ওই কালচারাল সেন্টারেই রয়েছে।
এর আগে পৃথিবীর বৃহত্তম কোরআন শরীফ তৈরির কৃতিত্বের দাবিদার ছিল রাশিয়া। গত বছর উন্মোচিত দেশটির তাতারস্তান অঞ্চলে নির্মিত ওই কোরআন শরীফটির পৃষ্ঠাগুলোর আয়তন ছিল দৈর্ঘ্যে ২ মিটার ও প্রস্থে ১ দশমিক ৫ মিটার। বৃহত্তম কোরআন শরীফ তৈরির প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে মূল হস্তলিপিকার মোহাম্মদ সাবির খেদ্রির সহযোগী হিসেবে ৯ জন ছাত্রও কাজ করেছেন।