সরকার এবার আমন চালের উৎপাদনের মূল্য নির্ধারণ করেছে ৩৭ টাকা ৯০ পয়সা। কিন্তু সরকারই এই চালের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করেছে ৩৬ টাকা।
গত ১১ নভেম্বর খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভায় চলতি মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে প্রতি কেজি ৩৬ টাকা দরে ছয় লাখ টন আমন চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু গত ১৩ নভেম্বর আমন চালের উৎপাদন ব্যয় ৩৭ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করে কৃষি মন্ত্রণালয়।
সাধারণত সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহের আগে কৃষি মন্ত্রণালয় একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে উৎপাদনের মূল্য নির্ধারণ করে। এই মূল্যের সঙ্গে লাভ যোগ করে সরকারিভাবে সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ হয়। কিন্তু এবার উৎপাদনের মূল্য থেকে আরও দুই টাকা কমিয়ে আমন সংগ্রহের মূল্য নির্ধারণ হয়েছে। সরকার নির্ধারিত ক্রয়মূল্য বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কৃষককে ন্যায্যমূল্য পেতেও সহায়তা করে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি মন্ত্রণালয় আমনের যে উৎপাদনের মূল্য নির্ধারণ করেছে বাজারে এর চেয়ে অনেক কম দামে চাল বিক্রি হচ্ছে। তাদের দাবি, এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না।
পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার মাছুয়াখালী গ্রামের কৃষক মো. বেলাল মৃধা জানান, এবার আমনের ফলন ভালো। ধান কাটা শুরু হয়েছে। কিন্তু বাজারে এখন ধানের দাম নেই। এক মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। প্রতি মণ ধানের দাম ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা না হলে কৃষকের লাভ থাকে না।
তিনি আরও জানান, বাজারে চালের দাম ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা। এতে কৃষকের খরচটা কোনো রকম উঠে আসছে।
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে চালের বাজার দর অনেক কম। বাজারে এখন ৩৩ থেকে ৩৫ টাকায় চাল পাওয়া যাচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উৎপাদন খরচ ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উৎপাদন খরচের মধ্যে একটু হেরফের আছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, উৎপাদন খরচ কোনো অবস্থাতেই ৩৫ টাকার বেশি হয় না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উৎপাদন খরচটা একটু বেশি ধরা হয়েছে।’
‘বাজার পরিস্থিতি, সবকিছু হিসাব করে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ-খবর নিয়ে আমরা আমনের ক্রয়মূল্য ৩৬ টাকা নির্ধারণ করেছি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী উৎপাদন খরচ ৩৫ টাকার কাছাকাছি সাড়ে ৩৪ টাকা পড়ে।’
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহাবুদ্দিন আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয় একটা হিসাব (আমনের উৎপাদনমূল্য) দিয়েছে। কৃষিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় আমন সংগ্রহের মূল্য নির্ধারণ হয়েছে। ওই সভায় অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই উপস্থিত ছিলেন। আমরা এককভাবে মূল্য নির্ধারণ করিনি।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. নাসিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আমাদের অ্যাসেসমেন্ট দিয়েছি, তারা (খাদ্য মন্ত্রণালয়) তাদের মতো করে একটি অ্যাসেসন্টে করেছেন। ওই সভায় (এফপিএমসি) সবকিছু নিয়ে আলোচনা শেষে ওই মূল্য (৩৬ টাকা কেজি দরে ক্রয়) নির্ধারণ হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা উৎপাদনের মূল্য বাস্তবতার নিরিখেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নির্ধারণ করি। জৈব সার, শ্রমের মজুরি (পারিবারিক ও ভাড়াকৃত শ্রম), জমি কর্ষণ বাবদ খরচ, সেচ ও ধান হতে চাল করার মিলিং খরচ (সিদ্ধ ও পরিবহনসহ) বিবেচনায় নিয়ে এই দাম নির্ধারণ হয়।’
‘(এফপিএমসি সভায়) মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরেকটি জিনিস বিবেচনায় নেয়া হয় যে, বাজারে কী দাম চলছে। বর্তমান বাজারে যেকোনো ভাবেই হোক চালের দাম একটু কম। বাজারে এখন চাল ৩৩ টাকা, এটাও একটা ফ্যাক্টর ছিল মূল্য নির্ধারণের জন্য। কৃষক বোরো ও আউশে ভালো ফলন পেয়েছে, এজন্য বাজারটা পড়তির দিকে’- বলেন কৃষি সচিব।
তিনি আরও বলেন, ‘বাজারের চেয়ে বেশি দামে কিনলে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হবেন, এ ধরনের অনেক কিছু হিসাব করে দাম নির্ধারণ হয়।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নীতি, পরিকল্পনা ও সমন্বয়) মোহাম্মদ নজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমনের উৎপাদনের মূল্য নির্ধারণে আমরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন ও কৃষি বিপণন অধিদফতরের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে সভায় বসি। সেই সভায় বিবিএস (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো), খাদ্য অধিদফতরসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা থাকেন।’
গত বছর আমনের উৎপাদনমূল্য, ধান ২৪ টাকা ৬৩ পয়সা, চালের ৩৭ টাকা ০২ পয়সা ছিল। তখন ৩৯ টাকা দরে ছয় লাখ এক হাজার ৯৮৪ টন আমন চাল সংগৃহীত হয়।
২০১৬ সালে আমন ধান উৎপাদনে কৃষকের কেজিপ্রতি ১৯ টাকা এবং চাল উৎপাদনে ২৯ টাকা ব্যয় হয়। তখন চালের সংগ্রহমূল্য ছিল ৩৩ টাকা।
এর আগের বছর (২০১৫) সরকার ৩১ টাকা দরে আমন চাল সংগ্রহ করে। তখন উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ধানে হয় ১৮ টাকা ৫০ পয়সা এবং চালে ২৮ টাকা ৫০ পয়সা।
২০১৪ সালে প্রতি কেজি আমন ধানের উৎপাদনে খরচ হয় ১৮ টাকা এবং চালে খরচ ছিল ২৮ টাকা। ওই বছর সরকার ৩২ টাকা দরে চাল কেনে।
২০১৩ সালে খরচ ছিল প্রতি কেজি ধানে ১৭ টাকা দুই পয়সা এবং প্রতি কেজি চালের ২৫ টাকা ৪২ পয়সা। তখন ৩০ টাকা দরে আমন চাল সংগ্রহ করেছিল সরকার।
এবার ডিসেম্বরে শুরু হয়ে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খাদ্য অধিদফতরের মাধ্যমে আমন সংগ্রহ করবে সরকার।