নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির উত্তাপ এখন প্রত্যেক শিবিরে। জোট ভেঙে গড়ছে জোট। মনোনয়ন নিয়ে নানা কৌশলে রাজনৈতিক দলগুলো। কী হবে নির্বাচনে? সেই আলোচনা এখন সর্বত্র। তবে রাজনীতির আলোচনায় এখন অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে জোটগুলোর প্রতি আস্থা-অনাস্থার বিষয়টি।
বিশেষ করে নতুন গঠন হওয়া জোট ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে এখন জোর আলোচনা চলছে। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টে ভর করেছে প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি-জামায়াত। এতে যেন বদলে গেছে রাজনীতির দৃশ্যপট।
ঐক্যফ্রন্টের হাত ধরে বিএনপির রাজনীতিতে গতি ফিরলেও মনোনয়ন নিয়ে সংকট কাটেনি এখনও। বিশেষ করে প্রার্থী চূড়ান্তে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষে নেতৃত্বে আস্থা তৈরি হলেও তৃণমূলে অনাস্থা বাড়ছে।
ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোর মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেকেই মনে করছেন, যোগ্যতা থাকলেও তারা বিএনপির কাছে কোণঠাসা প্রায়। কেন্দ্রীয় নেতারা যথাযথভাবে দরকষাকষি করতে পারছেন না বলে মনোনয়ন নিয়ে অসন্তোষ বিরাজ করছে কোনো কোনো দলে। তারা বলছেন, প্রতিটি আসনে বিএনপি একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়ে ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে অধিকতর চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে। এটি তাদের নির্বাচনী কৌশল হলেও শরিকদের জন্য মোটেও সুবিধার নয় বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
তবে ঐক্যফ্রন্টের কেন্দ্রীয় নেতারা অসন্তোষ বা অনাস্থার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তারা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সবার মন জয় করা সম্ভব নয়। টানাপোড়েন থাকবেই। তবে আলোচনার ভিত্তিতে ভালো কিছু হবে সামনে- তা প্রত্যাশার সময় এসেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণফোরামের মনোনয়নপ্রত্যাশী এক নেতা জাগো নিউজকে বলেন, দিন যাচ্ছে পানি পরিষ্কার হওয়ার পরিবর্তে আরও ঘোলা হচ্ছে। এখন রাজনীতিতে ধোঁয়াশা বিরাজ করছে। যে কৌশল নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা মনোনয়ন জমার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেই কৌশলে আমাদের মতো প্রার্থীরা চাপা পড়ে যেতে পারেন। মূলত বিএনপির সঙ্গে ফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা নিজ দলের অবস্থান পরিষ্কার করতে পারছেন না। এতে তৃণমূলে শুধু দ্বিধাই তৈরি হচ্ছে।
ঐক্যফ্রন্টের সমন্বয়ক ও গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু জাগো নিউজকে বলেন, ‘তৃণমূলের অনেকে ঐক্যফ্রন্টের বিষয়ে বাড়িয়ে কথা বলেন। আমি এবং ড. কামাল হোসেন বিএনপির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। আমাদের সঙ্গে তাদের ভালো যোগাযোগ রয়েছে। আমরা তো যে কাউকে মনোনয়ন দিতে পারি না, কারণ যাকে দেব তাকে তো পাস করে আসতে হবে। কোনো আসনে বিএনপি থেকে আমাদের যোগ্য প্রার্থী থাকলে সেটার জন্য অবশ্যই ফাইট করবো।’
‘মানুষের জন্য রাজনীতি করি। এখন যদি নিজের স্বার্থটাই দেখি, তাহলে তো আর রাজনীতি হলো না। আসন বণ্টন নিয়ে আমরা বসবো। পরে বিস্তারিত জানাবো।’
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিকদের জন্য সর্বোচ্চ ৬০ আসনে ছাড় দেয়ার অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে বিএনপি ৩০০ আসনেই তাদের মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে। এমন পরিস্থিতি ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ‘ঘোলাটে’ হিসেবে উল্লেখ করছেন।
তবে বিএনপির সিদ্ধান্তের বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও ঐক্যফ্রন্ট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটাতে অখুশি থাকি, একটাতে খুশি থাকি; সব মিলে ঠিকই আছে।’
তিনি বলেন, ‘আসন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে এখনও দরকষাকষি হয়নি। আমাদের আসনের জন্য চিঠি দেয়া হয়েছিল, সেই অনুযায়ী আমরা নয়টা সিট চেয়েছি।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ডা. জাহেদ উর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের আসন বণ্টন নিয়ে মতানৈক্য কিছু নেই। মূলত যেটা হয়েছে, বিএনপিরও পুরনো প্রার্থী রয়েছে। যখন জোট হয়, তখন কিছু টানাপোড়েন পড়ে- এগুলো কমন। আসন বণ্টন নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আমাদের যেমন প্রার্থী রয়েছে, বিএনপিরও এক আসনে নির্বাচন করার মতো দু-তিনজন প্রার্থী রয়েছেন। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।’
‘বিএনপি মন খারাপ করছে কিংবা আমরা মন খারাপ করছি- এমনটা নয়। আওয়ামী লীগের জোটের মধ্যেও এমন হচ্ছে, এটা স্বাভাবিক।’
তিনি আরও বলেন, ‘আসন বণ্টন নিয়ে এগুলো নির্ধারণে স্টিয়ারিং কমিটিও বসবে। নেতাদের মধ্যে, নিজেদের মধ্যেও আলোচনা হবে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর অন্তত ৫-৬ দিন সময় লেগে যাবে। মাত্র সবাই ঢাকার বাইরে থেকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে ঢাকায় ফিরছে। তাদের বসতে বসতে আরও দু-তিনদিন সময় লেগে যাবে।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমন্বয়কারী ও বিএনপি নেতা বরকতউল্লা বুলু জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসন বণ্টন নিয়ে দু-একদিনের মধ্যে স্টিয়ারিং কমিটি বৈঠকে বসবে। আমার মনে হয়, আসন বণ্টন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐক্যফ্রন্টের এক শরিক দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী বলেন, ‘আসন বণ্টন নিয়ে বিএনপি জটিলতা সৃষ্টি করছে। তারা যদি আন্তরিকতা না দেখায় তাহলে জোটের রাজনীতি করে কী হবে? তাদের এমন আচরণ থাকলে জোট এগিয়ে নেয়া কষ্টকর হয়ে যাবে।’
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘পিঠা ভাগ করতে গেলেও টানাটানি করতে হয়। এ কাজ একটা চ্যালেঞ্জ। আমি নিজেও ভাবতে পারিনি, আমাদের এ জোট এত দ্রুত গঠন করা যাবে। আপনারা অবশ্যই বোঝেন যে, যে কোনো জায়গায়, যে কোনো সমাজে কিছু কাড়াকাড়ি বিধিনিষেধ থাকে। ভাগ করা মানে কী? কেউ পাবে, তো কেউ পাবে না।’
প্রসঙ্গত, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু গত ১৩ অক্টোবর। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে তারা সাত দফা দাবি ও ১১টি লক্ষ্য ঘোষণা করে। যদিও উল্লেখযোগ্য কোনো দাবি ও লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি ঐক্যফ্রন্ট।