৫৮৯ মিনিটও ব্যাটিং করা যায় দেখালেন মুশফিক

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

প্রথম উইকেটরক্ষক হিসেবে টেস্টে দুটি ডাবল সেঞ্চুরির বিশ্ব রেকর্ড গড়লেন। তবে মুশফিকের এর চেয়ে বড় অর্জন সম্ভবত বাংলাদেশের পক্ষে বল ও মিনিটের হিসাবে টেস্টে দীর্ঘতম ইনিংসটা খেলা।

ক্রিকেটের জেনারেশন নেক্সট ভাবতে পারে, এ নিতান্তই গালগল্প। বলতে পারে, যাহ্‌, তা কখনো সম্ভব নাকি! সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে ৯৭০ মিনিট ব্যাটিং করেছিলেন হানিফ মোহাম্মদ। ১৯৫৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ব্রিজটাউন টেস্টে হানিফের সেই ইনিংসের সঙ্গে একটা গল্পও জুড়ে গেছে। গাছের ওপরে বসে হানিফ মোহাম্মদ টানা ১৬ ঘণ্টার ব্যাটিং দেখতে দেখতে এক ছেলে নাকি পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল। ২৪ ঘণ্টা পর হাসপাতালের বিছানায় চোখ মেলে তার প্রথম প্রশ্নটাই ছিল, ‘ইজ হানিফ স্টিল ব্যাটিং?’

খুব বেশি দিন আগে অবশ্য নয়, বছর তিনেক আগেই অ্যালিস্টার কুক ৮৩৬ মিনিট ব্যাটিং করেছিলেন। গ্য্যারি কারস্টেনের ৮৭৮ মিনিটের ইনিংসটিও আঠারো কি উনিশ শতকের ঘটনা নয়। তবে টেস্ট ক্রিকেটে এমন মেজাজি ব্যাটিংয়ের দেখা হররোজ মেলে না। আর বাংলাদেশের জন্য তো আক্রমণই শেষ কথা। এ কারণেই কি না, সেই অভিষেক টেস্টে আমিনুল ইসলামের পর ৫০০ মিনিট ধরে ব্যাটিংয়ের ঘটনা আর ঘটেনি। অবশেষে আমিনুলের ৫৩৫ মিনিটের ব্যাটিংয়ের রেকর্ডটা ভেঙে দিলেন মুশফিক। মিরপুর টেস্টে প্রথম ইনিংসে তিনি ব্যাট করেছেন ৫৮৯ মিনিট। টেস্ট ক্রিকেটে মিনিটের হিসেবে তো বটেই, বলের হিসেবেও এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম ইনিংস। ৪২১ বলের সামনা করেছেন ১০ মিনিট বিরতিতেই আবার উইকেটকিপিংয়ে নেমে পড়া মুশি!
মুশফিকের ২১৯ রানের অপরাজিত ইনিংসের পথে এত এত রেকর্ড আর অর্জন যোগ হয়েছে, হয়তো খুব বেশি আলোচনা হবে না মিনিটের হিসাবটি। তবে আজ সংবাদ সম্মেলনে ঘুরে ফিরে মুশফিক যে কথাগুলো বললেন, সেখান থেকে বাংলাদেশেরও অনেক কিছু শেখার আছে। যদি বাংলাদেশ টেস্টে ভালো করতে চায়, মুশফিকের এই ইনিংসটাকে ডকুমেন্টারি হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। এমনকি মুশফিকের নিজের জন্যও এই ইনিংসটা ছিল শিক্ষাসফর। টেস্টে এর আগে ৪০০ বল খেলেছিলেন আর একজনই, ২০১৩ সালে গল টেস্টে আশরাফুলের ৪১৭ মিনিট। সেই ইনিংসেই মুশফিক প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন। আজ তো টেস্ট ইতিহাসেই প্রথম উইকেটকিপার হিসেবে ক্যারিয়ারে দুটি ডাবল সেঞ্চুরি যোগ করলেন।
এমন নয় মুশফিক খুটখুট ব্যাটিং করেছেন। ১৮ চার ও এক ছক্কার এই ইনিংসে আক্রমণাত্মক হয়েছেন প্রায়ই। কিন্তু ধৈর্য, টেম্পারামেন্টের চরম পরীক্ষাও দিয়েছেন প্রতি মুহূর্তে। নিজের প্রিয় শটগুলো তূণ থেকে বেরই করেননি অনেক সময়। মুশফিকের জন্য সবচেয়ে বড় তৃপ্তি এটাই।
আজ বললেনও, ‘আমি এই ইনিংসে কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়েই খেলেছি। এটা আমার কাছে বড় ব্যাপার মনে হয়েছে। আমার যেগুলো প্রিয় শট, সেগুলো ছাড়াই যে আমি এত সহজে রান করতে পারি, এই বিশ্বাসটা এসেছে নিজের খেলার মধ্যে। পরের বার এমন হলে আমি সেই শটগুলোতে ফিরতে পারব। এটা এই ইনিংসে বড় অর্জন ছিল।’
৫ বছরের আগের ডাবল সেঞ্চুরির সঙ্গে এবারের ইনিংসে ব্যাটসম্যান মুশফিকের পার্থক্য কী ছিল, বলতে গিয়ে প্রথমে কৌতুক করলেন। তারপর মনে করিয়ে দিলেন টেস্ট ক্রিকেটের আসল সত্যিটা, ‘বদল যদি কিছু থাকে, তাহলে আমার দাড়িটা বড় হয়েছে। এ ছাড়া কিছু না। আগে খেয়াল করে দেখবেন, আমার প্রিয় শটে অনেক রান করেছি। কিন্তু এবার খেয়াল করলে দেখবেন আমি ওই শট ছাড়া অনেক রান করতে পেরেছি। শেষ পাঁচ সাত বছরে আমি ছোট শটেও অনেক বেশি রান করতে পারি। একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে এটা আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার।’

আর এমন একটা ইনিংস খেলার পথে প্রতি মুহূর্তে নিজেই নিজের শিক্ষক হয়ে ছিলেন মুশফিক, ‘টেস্ট খেলতে গেলে ধৈর্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন মিরপুরের উইকেটে খেলবেন ব্যাটসম্যান হিসেবে কখনো বলতে পারবেন না পরে কী আসছে। তবে এটা আজকে আমার জন্য বাড়তি সুবিধা ছিল। কারণ, অন্যান্য উইকেটে দেখা যায়, আমি অন্যান্য শট খেলতে যেতাম বা ভাবতাম এই বলটা এদিক খেলি। সে তুলনায় আমাকে এই উইকেটে প্রতিটি বলে গভীর মনোযোগ দিতে হয়েছে। কারণ, এখানে নতুন বা পুরোনো যে বলই হোক, হঠাৎ করে বাড়তি বাউন্স করেছে বা নিচু হয়ে গেছে। এখানে ব্যাটিং করাটা সহজ ছিল না। আর এই ব্যাপারটা এক দিক থেকে আমাকে সাহায্য করেছে।’

সাহায্য করেছে ধ্যানী হতে, ‘মনোযোগের ব্যাপারটা সাধনার। আর এটা সব সময় আসে না। আমি অনুশীলন সেভাবেই করা চেষ্টা করি যেন ম্যাচে এই ব্যাপারটা পাই। চেষ্টা করি মনোযোগ ধরে রেখে যত বেশিক্ষণ সম্ভব নেটে ব্যাটিং করার। একেক জনের প্রস্তুতি একেক রকম, তো আমার প্রস্তুতিটা এ রকম। এটা আমাকে বড় একটা আত্মবিশ্বাস দেয় যে, আমি আমার কাজটা করেছি সব ঠিক থাকলে আশা করি ম্যাচেও বাস্তবায়ন করতে পারব।’

টেস্টে ১৮ বছর পূর্তির মাত্র কদিন পর ৫০০ মিনিট ব্যাটিংয়ের দ্বিতীয় কীর্তি এল। মুশফিক নিজেই আজ বলছিলেন, প্রথম কেউ একবার কিছু করে ফেললে, বাকিদের মধ্যেও আত্মবিশ্বাস চলে আসে, হ্যাঁ, ও পারলে আমরাও পারব। মুশফিকের এই ইনিংসটা বাংলাদেশের সবার জন্য অনুপ্রেরণার হয়ে থাকবে নিশ্চয়ই।