বছর কয়েক আগে বলিউডে একটি সিনেমা মুক্তি পায়। নাম ছিল ‘স্পেশাল ২৬’। অক্ষয় কুমার-মনোজ বাজপেয়ি অভিনীত সিনেমাটি বেশ দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। সিনেমায় দেখানো হয়েছিল চোর-পুলিশের লুকোচুরি। প্রতারক অক্ষয়কে গ্রেপ্তার করার অভিযানে নেমেছিলেন সিবিআই কর্মকর্তা মনোজ। ছবিতে একজন সৎ সিবিআই কর্মকর্তার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মনোজ, যিনি কিনা সব প্রলোভন দূরে ঠেলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আর নকল সিবিআই কর্মকর্তা সেজেই প্রতারণা করতেন অক্ষয়।
কি ভাবছেন? ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি? আসলে আলোচনার মুখ্য বিষয় হলো, ভারতের সিবিআই বা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। আর ‘স্পেশাল ২৬’ চলচ্চিত্রে মনোজ বাজপেয়ি যেমন সিবিআই কর্মকর্তার ছবি এঁকেছিলেন, এখনকার সিবিআইয়ের সেই ভাবমূর্তি রসাতলে গেল বলে! ভারতের শীর্ষ তদন্ত সংস্থা হিসেবে সিবিআইয়ের খ্যাতি বেশ। তবে দুই শীর্ষ কর্তার ঝগড়ায় চরম বেকায়দায় পড়েছে সংস্থাটি। অবস্থা এমনই বেগতিক যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপেও সুরাহা হয়নি। শেষতক ঝগড়ায় মত্ত দুই শীর্ষ কর্তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে সরকার। এমন ঘটনায় সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি সিবিআইকে রাজনৈতিক রঙে রাঙানোর অভিযোগও শোনা যাচ্ছে জোরেশোরে।
ঘটনার কুশীলব দুই ব্যক্তি। একজন হলেন সিবিআইপ্রধান ও সংস্থাটির পরিচালক অলোক ভার্মা। অন্যজন হলেন সংস্থাটির বিশেষ পরিচালক রাকেশ আস্থানা। ১৫ অক্টোবর নিজেদের বড় কর্তা রাকেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন সিবিআই নিজেই। রাকেশ আস্থানাসহ মোট পাঁচজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, অভিযোগে বলা হয়েছে মাংস রপ্তানিকারক মইন কুরেশির বিরুদ্ধে থাকা মামলায় হস্তক্ষেপের বিনিময়ে আস্থানা ঘুষ নিয়েছেন। মইন কুরেশির বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে এই অভিযোগের অংশ হিসেবে অভিযুক্ত আরেক সিবিআই কর্মকর্তা দেবেন্দ্র কুমারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই দেবেন্দ্র আবার রাকেশের অধীনেই কাজ করতেন।
অভিযোগ রয়েছে, রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে কলকাঠি নেড়েছেন অলোক ভার্মা। কারণ শুরু থেকেই রাকেশের বিরোধী ছিলেন তিনি। ইকোনমিক টাইমস বলছে, এ ঘটনার আগেই অলোকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন রাকেশ। আর আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠনের পর আদালতে গিয়ে আগাম জামিন নেন রাকেশ আস্থানা। আদালতের আদেশে বলা হয়, আগামী সোমবার পর্যন্ত রাকেশকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।
অবশ্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তত দিন অপেক্ষা করেননি। তার আগেই দুই শীর্ষ কর্তাকেই ছুটিতে পাঠিয়েছেন। এনডিটিভির খবরে জানা গেছে, সিবিআইয়ের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান করা হয়েছে এম নাগেশ্বর রাওকে। রাকেশের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে বদলি করে পাঠানো হয়েছে আন্দামানের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে। বদলির কারণ হিসেবে ‘জনস্বার্থ’ শব্দটি ব্যবহার করেছে সরকার! এখন নিন্দুকেরা বলছেন, ‘নয়নের মণি’ রাকেশ আস্থানাকে বাঁচাতেই তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নিচ্ছেন মোদি। কারণ দুজনই উঠে এসেছেন গুজরাট রাজ্য থেকে। চলছে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা।
এদিকে এমন অভিনব ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। উপযুক্ত গোলা পেয়ে আর দেরি করেনি কংগ্রেস-সিপিএম। তোপ দাগা হচ্ছে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দিকে। বলা হচ্ছে, মোদি তাঁর স্নেহধন্য সিবিআই কর্মকর্তা রাকেশকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এতে সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নষ্ট হচ্ছে। এমনিতেই অভিযোগ আছে, গুজরাটে ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ছাড় দিয়েছিলেন রাকেশ। তাই পুরস্কার হিসেবে তাঁকেই সিবিআইপ্রধান বানাতে চেয়েছিলেন মোদি!
রাকেশ আস্থানা কে?
বেশ কিছু স্পর্শকাতর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন রাকেশ আস্থানা। এগুলোর মধ্যে আছে গোধরা হত্যাকাণ্ড ও বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদবের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত। এ ছাড়া ভারতীয় ধনকুবের বিজয় মাল্যর ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনায়ও তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এই রাকেশ। অন্যদিকে অগাস্টাওয়েস্টল্যান্ড চপার কেলেঙ্কারি এবং কংগ্রেস আমলের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগেরও তদন্ত রাকেশ আস্থানা করেছিলেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০২ সালে গুজরাটে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, তার সূত্রপাত হয়েছিল গোধরা হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। গুজরাট ক্যাডারের আইপিএস (ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস) অফিসার ছিলেন রাকেশ আস্থানা। গোধরা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত দলের প্রধান ছিলেন তিনি। নিন্দুকদের দাবি, দাঙ্গায় জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে মোদিকে খালাস দিয়েছিলেন রাকেশ। আর সেই থেকে মোদির ‘গুড বুকে’ নাম উঠে যায় তাঁর। মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ২০১৪ সালে কেন্দ্রে সরকার গঠনের পরই রাকেশকে সিবিআইয়ের কেন্দ্রীয় কাঠামোতে নিয়ে আসার তোড়জোড় শুরু হয়। একপর্যায়ে সিবিআইয়ের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তিতে পরিণত হন রাকেশ আস্থানা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, পর্যায়ক্রমে রাকেশকে সিবিআইপ্রধান বানাতে চেয়েছিলেন মোদি। মূলত সিবিআইয়ের মতো তদন্ত সংস্থাকে হাত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। কিন্তু সেই পরিকল্পনায় মই দিয়েছেন অলোক ভার্মা। আর এখন দুই কর্তার লড়াইয়ে মোদির সরকারই পড়ে গেছে ভাবমূর্তির সংকটে।
সিবিআই বনাম সিবিআই
গত বছরের অক্টোবরে রাকেশ আস্থানাকে পদোন্নতি দিয়ে সিবিআইয়ের দ্বিতীয় শীর্ষ কর্তা বানায় মোদি সরকার। তখন থেকেই সংস্থাটির প্রধান অলোক ভার্মার সঙ্গে তাঁর রেষারেষির সূত্রপাত, শুরু হয় ক্ষমতার লড়াই। বিশেষ পরিচালক পদে রাকেশের নিয়োগে আপত্তি জানিয়েছিলেন অলোক। কারণ হিসেবে সরকারকে জানিয়েছিলেন, দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগে রাকেশের নাম থাকার কথা। কিন্তু মোদি সরকার তাতে পাত্তা দেয়নি।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম লাইভ মিন্ট বলছে, চলতি বছরের জুলাইয়ে অলোক ও রাকেশের ঝগড়া প্রকাশ্যে চলে আসে। নিজের অনুপস্থিতিতে সংস্থার প্রধান হিসেবে ভূমিকা রাখার সুযোগ থেকে রাকেশকে সরিয়ে দেন অলোক। সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে এ কথা জানিয়েছিলেন তিনি। দুজনের মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছিল। গত সেপ্টেম্বরে বোমা ফাটান রাকেশ।
এ সময় সরকারের কাছে লেখা চিঠিতে অলোকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন রাকেশ আস্থানা। তিনি বলেন, ঘুষ নিয়ে মামলার দফারফা করছেন অলোক। রাকেশ আরও বলেন, সতীশ বাবু সানা নামের অন্ধ্রের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২ কোটি রুপি ঘুষ নিয়েছেন অলোক। আনা হয় রাকেশের কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপের অভিযোগও।
এরপরই ঘটে কিছুদিন আগের এফআইআর দায়েরের ঘটনা। মজার বিষয় হলো, এবারও এসেছে সতীশ বাবু সানার নাম। তিনি নাকি সিবিআইয়ের কাছে রাকেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন! এফআইআরে লেখা হয়েছে, আস্থানা সতীশের কাছ থেকে ৩ কোটি রুপি ঘুষ নিয়েছেন। রাকেশের সহযোগী হিসেবে এসেছে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার নামও।
এবার কী হবে?
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, অলোক ও রাকেশের ঝগড়া মেটাতে দুজনকে ডেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে সেই আলোচনায় যে ফল হয়নি তা বুধবারের ঘটনাতেই পরিষ্কার। এবার ‘ড্যামেজ কন্ট্রোলে’ নেমেছেন মোদি। দুই কর্তাকে ছুটিতে পাঠিয়ে বিজেপি সরকার বলছে, সংস্থার ঐক্য ধরে রাখতেই এই সিদ্ধান্ত।
এনডিটিভি বলছে, এরই মধ্যে নতুন সিবিআই প্রধান নাগেশ্বর রাও-এর বিরুদ্ধেও আপত্তি উঠেছে। তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক দল ডিএমকে-এর শীর্ষ নেতা এমকে স্টালিন বলেছেন, নাগেশ্বর রাওয়ের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ অলোক ভার্মার কাছে পাঠানো হয়েছিল। এমনকি ওই সব অভিযোগের তদন্ত শুরু করার উদ্যোগও নিয়েছিলেন ভার্মা। আর সেই ব্যক্তিই এখন হয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সিবিআইপ্রধান!
অন্যদিকে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর অভিযোগ, রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনাকাটায় দুর্নীতির বিষয়ে নথিপত্র সংগ্রহ করছিলেন অলোক ভার্মা। আর সেই কারণেই তাঁর ওপর খড়্গ চালিয়েছে মোদি সরকার। রাকেশ আস্থানাকে নরেন্দ্র মোদির ‘নয়নের মণি’ অভিহিত করে রাহুল আরও বলেছেন, ভারত ও ভারতের সংবিধান এখন বিপদাপন্ন।
বিজেপি অবশ্য দলীয়ভাবে প্রকাশ্যে কোনো পক্ষ নেয়নি। এক সংবাদ সম্মেলনে বিজেপির মুখপাত্র মীনাক্ষী লেখি বলেছেন, ‘এখানে দুটি প্রতিবেদন আছে। একটি পরিচালকের বিরুদ্ধে, আবার আরেকটি বিশেষ পরিচালকের বিরুদ্ধে। আমরা চাই, সিবিআইয়ের মতো সংস্থার ওপর জনগণের বিশ্বাস যেন অটুট থাকে।’
তবে সরকার সরিয়ে দিলেও দমে যাওয়ার পাত্র নন অলোক ভার্মা। পদ ফিরে পেতে বুধবারই সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দায়ের করেছেন তিনি। মোদি সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছেন, তদন্ত রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে না যাওয়াতেই আজ তাঁর এই দশা। আগামী শুক্রবার এই পিটিশনের ওপর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। যদি শুনানির পর আদালত অলোকের পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত দেন, তবে ফের বেকায়দায় পড়বেন নরেন্দ্র মোদি। ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ আর হবে না। উল্টো মোদি সরকারের ভাবমূর্তি ‘ড্যামেজ’ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে!