ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন ৬৪ জেলা ঘুরে দেখবেন। কিন্তু মানুষের সব স্বপ্ন কি সত্যি হয়? অর্থনৈতিক কারণে পারিবারিক অনীহায় সে স্বপ্ন সত্যি হয়নি। তবে এমন এক স্বপ্নকে তিনি সত্যি করেছেন, যেখানে এক জায়গায় বসেই ছুঁয়ে দেখতে পারবেন ৬৪ জেলার মাটি। সেই স্বপ্ন বালকের নাম শুভঙ্কর শুভ। দেশপ্রেমে মগ্ন হয়ে দেশের জন্য কিছু করতে পারাটাই লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছেন তিনি। সেই স্বপ্ন পূরণে সময় লেগেছে তিন বছর। তরুণ এ স্বপ্ন বালকের গল্প শোনাচ্ছেন রিফাত কান্তি সেন-
পরিচয়: শুভঙ্কর জন্মেছেন মাগুরায় মামা বাড়িতে। কিন্তু বেড়ে ওঠা ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার বারাংতুলা গ্রামে। বাবা নিহার রঞ্জন পাল এবং মা অমিতা পাল। ছোটবেলা থেকেই দুরন্তপনা ছিল তার মাঝে বিদ্যমান। বাবা পল্লী চিকিৎসক। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। বাড়িতে কাকা দিলীপ কুমার পাল মাটি দিয়ে বিভিন্ন মূর্তি গড়তেন। কাকার সাথেই মাটির জিনিসে হাত লাগানোর অভ্যাস তার ছোটবেলা থেকেই।
স্বপ্নের শুরু: ছোটবেলা থেকেই শুভঙ্কর স্বপ্ন দেখতেন দেশের প্রতিটি জেলা ঘুরে বেড়াবেন। সে স্বপ্ন সত্যি হয়নি ঠিকই কিন্তু ৬৪ জেলার মাটি এনে গড়েছেন মানচিত্র। তার নতুন স্বপ্ন এক জায়গায় বসেই বাংলাদেশটাকে ছুঁয়ে দেখা। আইডিয়াটা এভাবেই মাথার মধ্যে চেপে বসে। তিনি ভাবতে লাগলেন, বাংলাদেশ নিয়ে ব্যতিক্রম কিছু করা যায় কি-না! যা কি-না আগে কেউ করেনি। তাই অনলাইন ঘেঁটে দেখলেন, ৬৪ জেলার মাটি একফ্রেমে কেউই আনেনি আগে। শুরু করলেন কাজ।
কাজের শুরু: কাগজ দিয়ে টুকিটাকি শিল্পকর্ম করার হাত ছিল তার। সুযোগ পেলেই নানা জিনিস বানাতেন। যেমন কাগজের তাজমহল, বায়োস্কোপ, ক্যামেরা ইত্যাদি। এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিন দিন ধরে বাংলাদেশের ম্যাপের ওপর ৬৪ জেলার জন্য ৬৪ জেলার কাগজের বক্স তৈরি করেন। এর পরের টার্গেট ছিল মাটি আনা।
যেভাবে মাটি আনেন: ৬৪ জেলায় না যেতে পারলেও ৬৪ জেলার মাটি আনার চিন্তা তাকে পেয়ে বসে। যে কোন মূল্যে মাটি আনতেই হবে। এ কাজে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ প্রচারণা চালান। প্রথম প্রথম নিজেই কয়েকটি জেলার মাটি সংগ্রহ করতে থাকেন। এরপর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতা চাইলেন। তিনি চেয়েছিলেন ৬৪ জেলার ৬৪ হাতের স্পর্শ লেগে থাকুক। প্রথম প্রথম কেউ আগ্রহ না দেখালেও পরে কিন্তু অনেকেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে থাকে।
বিড়ম্বনা: মানচিত্রটি গড়তে গিয়ে একসময় মন ভেঙে পড়ে শুভঙ্করের। অনেকেই মাটি পাঠাবে বলে ছবি পাঠান কিন্তু মাটি পাঠান না। কুরিয়ারে গিয়ে অনেক সময়ই খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাকে। অনেকে আবার বিরক্তও প্রকাশ করেছে। মনে মনে ভাবতেন, ৫০০ গ্রাম মাটি তো কত লোক কত জেলা থেকে পাঠালো। আর কিছু লোক এমন ছলনা করছে। তাহলে কী তার মানচিত্র গড়ার স্বপ্নটি ব্যর্থ হবে!
অপেক্ষার প্রহর: মানচিত্রটি গড়তে তিন বছর সময় লেগেছে শুভঙ্করের। অনেক প্রতিকূলতা পার হয়ে এখন সে সত্যিকারের স্বপ্নের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। তিন বছরের অভিজ্ঞতায় যেমন ভালো দিক ছিল; তেমনি খারাপ দিকও ছিল। অনেকের কাছে শুনতে হয়েছে, শুভঙ্কর নিজেকে ফেমাস করে তুলতেই এমন কাজে হাত দিয়েছে। কিন্তু সব সমলোচনাকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে সফলতার মুখ শুভঙ্করই দেখেছে। বেশ কিছু জেলার মানুষ, ফরিদপুর জেলা প্রশাসকসহ এ কাজে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ সাহায্য করেছে। মানচিত্রটির দৈর্ঘ্য ২৮ এবং প্রস্থ ১৮ সে.মি। মানচিত্রটি রাখা হয়েছে কাঁচঘেরা একটি বাক্সে। মানচিত্রের প্রতিটি জেলা তৈরি হয়েছে সে জেলার মাটি দিয়ে।
শুভঙ্করের বক্তব্য: তিনি বলেন, ‘আমি কেবল স্বপ্ন দেখেছিলাম মানচিত্র গড়ার। আপনারা যারা মানচিত্রের মাটি সংগ্রাহকের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন, আপনারাই এই মানচিত্রের প্রকৃত কারিগর। যতদিন এই মানচিত্র থাকবে; ততদিন আপনাদের নাম থাকবে। এই মাটির মানচিত্র হোক বাংলাদেশ নিয়ে অগণিত সৃষ্টিশীল প্রাণের স্বপ্ন গড়ার একবিন্দু অনুকণা- এতেই আমার সার্থকতা।