অরক্ষিত ক্রসিং, গেটম্যানের অবহেলা আর জনসচেতনার অভাবে মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে রেলপথের লেভেল ক্রসিংগুলো। এসব কারণে প্রায়ই ঘটছে প্রাণহানির মতো ঘটনা। গত কয়েকমাসে লেভেল ক্রসিংগুলোতে রেলের সঙ্গে অন্যান্য পরিবহনের সংঘর্ষে ও ট্রেনে কাটা পড়ে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
সর্বশেষ গতকাল রোববার (২ সেপ্টেম্বর) ভোরে চট্টগ্রামের বারৈয়ারহাট লেভেল ক্রসিংয়ে ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে আসা বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে খাগড়াছড়িগামী এস আলম পরিবহনের একটি বাসের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দুই বাসযাত্রী নিহত হন। আহত হয়েছেন অন্তত আরও ২৫ জন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গেটম্যানের অবহেলার কারণে গতকাল বারৈয়ারহাট লেভেল ক্রসিংয়ে ওই ভায়বহ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর থেকে রেল ক্রসিংয়ের দায়িত্ব থাকা গেটম্যানের নাম মো. আরিফ পলাতক রয়েছে।
গেটম্যানদের অবহেলায় বারৈয়ারহাট লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা কোনো নতুন বিষয় নয়। ২০১৬ সালের ৩১ জুলাই আরও একবার দুর্ঘটনায় পতিত হয় ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে আসা বিজয় এক্সপ্রেস। গতকালের মতোই ভোর ৪টার দিকে চট্টগ্রামমুখী বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনটি ধাক্কা দেয় খাগড়াছড়িগামী রিফাত পরিবহনকে। ওই দুর্ঘটনায় কেউ মারা না গেলেও ১৫ জন বাসযাত্রী আহত হন। সেদিন গেটম্যান ছাবের ঘুমিয়ে ছিলেন।
ওই দুর্ঘটনার মাত্র সাত দিন আগে ২৪ জুলাই এই লেভেল ক্রসিংয়েই গেটম্যানের অবহেলার বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পরতে যাচ্ছিল চট্টগ্রামমুখী আন্তঃনগর ট্রেন সোনার বাংলা। তবে একদম শেষ মুহূর্তে চালকের বিচক্ষণতায় অল্পের জন্য রক্ষা পায় হাজারখানেক যাত্রী। সেই দিনও লেভেল ক্রসিংয়ে গেট না ফেলে অন্যত্র চলে যায় গেটম্যান ছাবের। পরে গেট থেকে প্রায় ৩শ গজ দূরে বারইয়ারহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে চালক ট্রেনটি থামান।
বিভিন্ন সময় ট্রেন দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। এর মধ্যে রয়েছে অবৈধ লেভেল ক্রসিং, বৈধ ক্রসিংগুলোতে প্রয়োজনীয় গেটম্যান না থাকা, গেটম্যানদের গাফিলতি এবং যথাযথ সিগন্যালের অভাব, সিগন্যাল না মানা ও অসাবধানতা।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত ২০ বছরে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ৫৭০টিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের গত আট মাসে রেললাইনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৩২০ জনের। ২০১৭ সালে মৃত্যু হয়েছে ৮১২ জনের। ২০১৬ সালে রেল দুর্ঘটনা ও রেললাইনে কাটা পড়ে মারা যান ৩০৫ জন। ২০১৫ সালে মারা গেছেন ২৯২ জন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ লেভেল ক্রসিংয়েই কোনো গেটম্যান নেই। এর বাইরে আরও সহস্রাধিক অবৈধ লেভেলক্রসিং থাকলেও এগুলোতেও নেই কোনো নজরদারি। গেটম্যানবিহীন লেভেল ক্রসিংগুলোতে যানবাহন ও পথচারীদের নিজ দায়িত্বে চলাচলের জন্য সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখে দায় সারছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ফলে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে একের পর এক প্রাণ।
রেলের পূর্বাঞ্চলে ১ হাজার ২৪৫টি বিভিন্ন ধরনের লেভেল ক্রসিং রয়েছে। রেলের পূর্বাঞ্চলের হিসেবে অবৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা ৮৮১টি। এর বাইরে আরও সহস্রাধিক অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। বৈধ ক্রসিংগুলোতেও আবার প্রয়োজনীয় গেটম্যান নেই। প্রায় সাড়ে ১২শ’ বৈধ ক্রসিং তদারকির জন্য স্থায়ী গেটম্যান রয়েছেন মাত্র ৪৩৪ জন।
সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে পাওয়া তথ্য মতে, রেলের পূর্বাঞ্চলে এলজিইডির অধীনে ২৫৩টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। সড়ক ও জনপথের ৬, পৌরসভা ৬৫, সিটি করপোরেশন ১৯, ইউনিয়ন পরিষদ ৩২৪, জেলা পরিষদ ১৩, বেসরকারি সংস্থা ৩, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৩ এবং অন্যান্য সংস্থার অধীনে ৯২টি ক্রসিং রয়েছে। বাকি ৩৩টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং কার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তা জানে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল জলিল বলেন, ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) আওতায় গ্রামীণ সড়ক পাকা হওয়ায় যানবাহনের সংখ্যা ও রাস্তা উভয়ই বেড়েছে। কী পরিমাণ সড়ক ও কত যানবাহন বাড়ল তার প্রকৃত হিসাব বা তথ্য রেল কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। একই কারণে রেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই অননুমোদিত রেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা বেড়েছে। রেলগেট সুরক্ষার ব্যয় সংকুলান করতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ। তার পরেও গত ফেব্রুয়ারি মাসে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা রোধে লেভেল ক্রসিংয়ে ১ হাজার ৩৮ গেটম্যান নিয়োগ দিয়েছে রেলওয়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রেলের পূর্বাঞ্চলে ১ হাজার ২৪৫টি বিভিন্ন ধরনের লেভেল ক্রসিং রয়েছে। অবৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা আরও সহস্রাধিক। এ অবস্থায় নতুন নিয়োগ পাওয়া অস্থায়ী গেটম্যান দিয়েও সব লেভেল ক্রসিংয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। একটি লেভেল ক্রসিংয়ে তিনজন করে গেটম্যান কাজ করলেও মাত্র ৩৪৬টি লেভেলক্রসিং সুরক্ষিত করা যাবে।’