পেনাল্টি থেকে আঁতোয়ান গ্রিজমানের গোলের পরই কি বিদায়ের ঘণ্টা শুনতে পেয়েছিল আর্জেন্টিনা! ফরাসি এই ফরোয়ার্ড গোল পেলে যে ফ্রান্স কখনো হারে না। কাজানে আজও এই পরিসংখ্যানটা অটুট থাকায় বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়ে গেল আর্জেন্টিনার। ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলের হারে শেষ ষোলো থেকে বিদায় ঘটল লিওনেল মেসিদের।
বিশ্বকাপে এর আগে ফ্রান্সের কাছে কখনো হারেনি আর্জেন্টিনা। কিন্তু সেই ইতিহাসটা আজ পাল্টে যাওয়ার পেছনে ‘মেসি’দের অবদানই বেশি। অগোছালো মাঝমাঠ আর তাসের ঘরের মতো ভঙ্গুর রক্ষণভাগ বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে ফেলেছে আকাশি-সাদা স্বপ্ন। ১৯৭৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কাছে হারের পর থেকে কোনো লাতিন দলের কাছে কখনোই হারেনি ফ্রান্স। ৪০ বছর পর সেই আর্জেন্টিনাকে পেয়েও থামেনি ফরাসি জয়রথ।
সাত গোলের এই ম্যাচে আর্জেন্টিনার আক্ষেপ হয়ে থাকবে শেষ দিকে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা। এনজো পেরেজের বদলে বদলি হয়ে মাঠে নামা সার্জিও আগুয়েরো যোগ করা সময়ে গোল করলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। স্কোরলাইনে আর্জেন্টিনা যে তখনো ৪-৩ গোলে পিছিয়ে। শেষ পর্যন্ত চার গোল হজম করেই বিদায় নিতে হলো হোর্হে সাম্পাওলির শিষ্যদের।
প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার শুরুটা ছিল বেশ অগোছালো। ৪-৩-৩ ফরমেশনে মেসি খেলেছেন ‘ফলস নাইন’ স্ট্রাইকার হিসেবে। গোল করার সঙ্গে খেলা তৈরির গুরুদায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। কিন্তু বিরতির আগে ফ্রান্সের রক্ষণভাগে মেসিকে সেভাবে ত্রাস ছড়াতে দেখা যায়নি। ফরাসি বক্সের মধ্যে প্রথম বল পেয়েছেন ৩৭ মিনিটে। রাখতে পারেননি। তাঁকে কোনো জায়গা দেননি উমতিতি-ভারানেদের রক্ষণ। বার্সেলোনায় ‘ফলস নাইন’ হিসেবে বাঁ প্রান্ত দিয়ে যেভাবে ‘কাট-ইন’ করে ঢুকে থাকেন, সেই মেসিকে প্রথমার্ধে দেখা যায়নি আকাশি-সাদায়।
উল্টো কিলিয়ান এমবাপ্পের বিদ্যুৎগতি ভীষণ ভুগিয়েছে গাবি মার্কাদো-ওটামেন্ডি-রোহোদের। প্রথমার্ধে তিনটি ‘কাউন্টার অ্যাটাক’ করেছে ফ্রান্স। এর মধ্যে দুটিতেই এমবাপ্পেকে থামাতে হলুদ কার্ড দেখেছেন মার্কোস রোহো ও নিকোলাস ত্যাগলিয়াফিকো। এর মধ্যে ১৩ মিনিটে ফ্রান্স পেনাল্টি পেয়েছে এমবাপ্পের বিদ্যুৎগতির দৌড়ের জন্যই।
নিজেদের অর্ধে বল পেয়ে এক দৌড়ে আর্জেন্টাইন রক্ষণে ঢুকে পড়েন এমবাপ্পে। তাঁকে থামাতে বক্সে ফাউল করেন রোহো। আর্জেন্টিনাকে আগের ম্যাচে জেতানো এই ডিফেন্ডার বক্সের বাইরে কেন এমবাপ্পেকে থামালেন না, সেই প্রশ্ন থাকবে। পেনাল্টি থেকে গ্রিজমানের গোলের পরই আশায় বুক বেঁধেছিলেন ফরাসি সমর্থকেরা। বিশ্বকাপে সর্বশেষ ১৮ ম্যাচে ফ্রান্স আগে গোল পেয়ে কখনো হারেনি। কিন্তু তারকাদের জন্মই তো পরিসংখ্যান পাল্টে দেওয়ার জন্য। ৪১ মিনিটে অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া ঠিক সেই কাজটাই করার চেষ্টা করেছেন।
বাঁ প্রান্ত থেকে ডি মারিয়াকে পাস বাড়িয়েছেন এভার বানেগা। ফরাসি বক্সের ঠিক সামনে ফাঁকা দাঁড়িয়ে ছিলেন ডি মারিয়া। পাসটা পেয়ে বক্সে আর কাউকে খেলাননি। ২৫ গজি দূরপাল্লার শটে সমতা এনে ডি মারিয়া যেন বুঝিয়ে দিলেন, এখনো ফুরিয়ে যাননি। গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচে বাজে খেলার স্মৃতিটা এই উইঙ্গার মুছে দিয়েছেন ছবির মতো সুন্দর এক গোল করে। ডি মারিয়ার এই গোলটার আগে ফ্রান্সের গোলপোস্ট তাক করে আর্জেন্টিনা কোনো শট নিতে পারেনি। ওটাই ছিল প্রথম শট।
প্রথমার্ধে মেসিদের পায়েই বেশি সময় বল ছিল। ৬৪ শতাংশ বল দখলে রেখেছেন তাঁরা। কিন্তু ডি মারিয়ার একক প্রচেষ্টায় ওই গোলটি ছাড়া বলার মতো কিছু করতে পারেনি হোর্হে সাম্পাওলির আক্রমণভাগ। এর আগে ৯ মিনিট ফ্রিকিক থেকেই এগিয়ে যেতে পারত ফ্রান্স। হাভিয়ের মাচেরানো ফাউল করায় ২৫ গজ দূর থেকে ফ্রিকিক পেয়েছিল ফ্রান্স। গ্রিজমানের শট আর্জেন্টাইন গোলবার কাঁপিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
ডি মারিয়ার গোলের পর কিছুটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছিল আর্জেন্টাইন আক্রমণভাগ। শেষ দিকে তারা ফরাসি বক্সে ঢোকার কয়েকটি চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রথমার্ধ থেকেই আর্জেন্টাইন মিডফিল্ড গোছালো খেলতে পারেনি। পাসগুলো ছিল এলোমেলো আর ফরাসি বক্সের সামনে মেসিকে পাভোন-বানেগারা খেলাতে পারেননি। উল্টো বিরতির পর আর্জেন্টাইন রক্ষণের সামনে সুবাস ছড়িয়েছে ফরাসি আক্রমণভাগ।
তবে বিরতির পর আর্জেন্টিনাই ২-১ গোল ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েছিল। ৪৮ মিনিটে ফ্রিকিক থেকে বল পেয়েছিলেন মেসি। গাবি মার্কাদোর পায়ের ছোঁয়ায় তাঁর শটের গতিপথ পাল্টে বল আশ্রয় নেয় জালে। কিন্তু এই ম্যাচে পরের চিত্রনাট্যে শুধুই ফরাসি সৌরভ। মার্কাদোর গোলের ৯ মিনিট পর আর্জেন্টাইন বক্সে জটলা থেকে বল পেয়েছিলেন বেনিয়ামিন পাভার। বুলেট গতির শটে আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক ফ্রাঙ্কো আরমানিকে কোনো সুযোগই দেননি।
২-২ গোলে সমতায় ফেরে ফ্রান্স। এখান থেকে ম্যাচটা আরও জমজমাট হতে পারত। কিন্তু পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের ভাগ্যকে মাত্র ৪ মিনিটের মধ্যে নিজেদের করে নেন এমবাপ্পে। ৬৪ মিনিটে আর্জেন্টাইন বক্সে বল পেয়ে কয়েক টাচে দুই ডিফেন্ডারকে ছিটকে ফেলে সুবিধাজনক জায়গা থেকে ১৯ বছর বয়সী ফরোয়ার্ডের কিক শেল হয়ে বিঁধেছে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের বুকে। ৩-২ গোলে এগিয়ে যায় ফ্রান্স।
ঠিক তার ৪ মিনিট পরই ম্যাচের ভাগ্য লিখে দেওয়ার সঙ্গে মাচেরানোদের হাতে বিদায়ের টিকিট ধরিয়ে দেন এমবাপ্পে। এবারও সেই একই ভুল। রক্ষণভাগ খালি রেখে বারবার আক্রমণে উঠেছে আর্জেন্টাইন রক্ষণভাগ। এই সুযোগে মুহুর্মুহু পাল্টা আক্রমণে মাচেরানো-ওটামেন্ডি-ফ্যাজিওদের রক্ষণভাগ এলোমেলো করেছেন পগবা-গ্রিজমান-এমবাপ্পেরা। ৬৮ মিনিটে এমবাপ্পের শেষ গোলটিও তারই ফসল।
শেষ পর্যন্ত ফলটা ৪-৩ বলে আর্জেন্টিনা সমর্থকেরা আফসোস করতে পারেন। ইশ্, আরেকটা গোল হলে! শেষ মুহূর্তে তো তিনটা গোলের সুযোগ তৈরি করেছিল মেসিরা! কিন্তু এই হতাশায় আড়াল করা যাবে না, বিশ্বকাপের জন্য ভালো একটা স্কোয়াড নিয়েই আসতে পারেনি আর্জেন্টিনা। গোলরক্ষক নেই, ফ্রান্সের গতিশীল ফুটবলকে প্রথম ধাক্কায় দুর্বল করে দেওয়ার মতো মিডফিল্ড নেই। আর রক্ষণ তো সেই চিরচেনা চেহারায়।
গতিতেই দুর্গতি হয়েছে আর্জেন্টিনার। মাঝমাঠে পুরো ম্যাচে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ফ্রান্সের। সেখান থেকেই ডিফেন্স চিড়ে বেরিয়ে গেছে একের পর এক পাস। এমপাপ্পে ঘণ্টায় ৩৫ কিংবা এরও বেশি গতিতে ছুটে বেরিয়ে গেছেন। অদৃশ্য মাঝমাঠ, দুর্বল রক্ষণ আর শিক্ষানবিশ গোলরক্ষক নিয়ে বিশ্বকাপে মঞ্চে লড়াই করা যায় না।
নিজেদের আন্তর্জাতিক ফুটবল নিয়ে একদম নতুন করে না ভাবলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়া এক দলে পরিণত হবে তারা। ফ্রান্স আজ শুধু তাদের হারালই না, দিয়ে গেল এই বার্তাও।