>> সরকারি চার ব্যাংকের ঘাটতি নয় হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা
>> বেসরকারি আট ব্যাংকের এক হাজার ৬২ কোটি টাকা
ব্যাংক খাতে বেড়েছে মন্দ বা খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে দেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১২টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। যার সিংহভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের।
গত ৭/৮ বছরে ব্যাংক খাতে ঋণের নামে টাকা লুট হয়েছে। সরকার এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা মার্চ’ ১৮ প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
ব্যাংক ব্যবস্থার ঋণের শ্রেণিমান অনুযায়ী, নির্ধারিত পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতির অর্থ সংরক্ষণের বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালী, বেসিক ও অগ্রণী ব্যাংক। বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইএফআইসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।
প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থদের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক, আইএফআইসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন রাখতে হয়। খেলাপি বাড়ার কারণে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে তাদের মূলধন ঘাটতি হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
যেসব খেলাপি তিনবারের বেশি পুনঃতফসিল করেছে তারা যাতে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিয়মিত হয়- এমন নির্দেশনা দিতে হবে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মার্চশেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট লাখ ২২ হাজার ১৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর’ ১৭ শেষে ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা।
আলোচিত সময়ে ১২ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫৯৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি সোনালী ব্যাংকের। মার্চশেষে সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৯৪৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এরপরই বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি তিন হাজার ৩০৭ কোটি ১০ লাখ, রূপালী ব্যাংকের এক হাজার ২৬৮ কোটি ৩৩ লাখ এবং অগ্রণী ব্যাংকের এক হাজার নয় কোটি ৬১ লাখ টাকা।
বেসরকারি খাতের আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি এক হাজার ৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে এবি ব্যাংকের
১৫৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১৯৯ কোটি ৮৫ লাখ, আইএফআইসির ২৯ কোটি ৪১ লাখ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১১৪ কোটি ৩৭ লাখ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৪০ কোটি ২০ লাখ, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১১৯ কোটি ৫৯ লাখ, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২৩৬ কোটি ৩৪ লাখ ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৬৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন রাখতে হয়। যেহেতু খেলাপি বেড়েছে তাই প্রভিশন ঘাটতিও বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘গত ৭/৮ বছরে ব্যাংক খাতে ঋণের নামে টাকা লুট হয়েছে। সরকার এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো কিছু বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের দিয়ে এ খাত আরও অস্থির করেছে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংক খাতে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ ডেপুটি গভর্নর বলেন, ‘খেলাপির বিষয়ে এখনই বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রদক্ষেপ নিতে হবে। যারা দীর্ঘদিন খেলাপি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব খেলাপি তিনবারের বেশি পুনঃতফসিল করেছে তারা যাতে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিয়মিত হয়- এমন নির্দেশনা দিতে হবে।’
‘যারা নিয়মিত না হবে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। খেলাপিদের নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, খেলাপিদের ধরতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত হতে হবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৪৯ হাজার ২৩৯ কোটি ছয় লাখ টাকা। এর বিপরীতে সংরক্ষণ হয়েছে ৪১ হাজার ২৮০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ফলে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৯৫৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা। তবে একক ব্যাংক বিবেচনায় এর পরিমাণ আরও বেশি। কারণ অনেক ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি প্রভিশন সংরক্ষণ করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশির ভাগই আমানতকারীদের অর্থ। তাদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশন সংরক্ষণ।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। খেলাপি ঋণ বাড়লে, আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শেয়ারহোল্ডাদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না।