মাদক ব্যবসায়ী নয়, সৎ মানুষ ছিলেন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত একরামুল

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

মাদকবিরোধী অভিযানে র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে সুনির্দিষ্ট তথ্য ‍পাওয়া গেছে। এমন কি পুলিশও বলছে, তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাই ছিল না।

শনিবার দিবাগত রাতে র‌্যাবের সাথে ওই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন টেকনাফের ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর একরামুল হক।

চ্যানেল আই অনলাইনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে একরাম কখনোই মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিলেন না। তার পরিবারের সদস্য, এলাকার রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং সাধারণ মানুষও স্বীকার করেছেন তিনি ছিলেন একজন সৎ মানুষ।

শুধু স্থানীয় আওয়ামী লীগই নয়, একরামের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিও বলছে একরামুল হক ছিলেন সৎ মানুষ, ভালো মানুষ।

অনুসন্ধানে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় উঠে এসেছে। কেউ বলছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় তার নাম উঠানোয় নিহত হন একরাম।

কেউ আবার বলছেন, একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার প্রতিহিংসার জেরে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে।

এই ঘটনাকে ‘বড় ভুল’ উল্লেখ করে কেউ আবার এর জন্য  প্রশাসনকে দায়ি করছে।

র‌্যাবের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ভুল
একরামুল হকের মৃত্যুর পর র‌্যাবের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে একরামুলের নাম ঠিক থাকলেও ভুল ছিল পিতার নামে। সঠিক ছিল না তার স্থায়ী ঠিকানাও।

র‌্যাব জানায়, নিহত কাউন্সিলরের বাবার নাম: মোজাহার মিয়া ওরফে আব্দুস সাত্তার এবং তিনি কক্সবাজার জেলার টেকনাফের নাজিরপাড়া এলাকার বাসিন্দা বলে জানিয়েছে। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা জানায়, নিহত কাউন্সিলরের বাবার নাম আব্দুস সাত্তার এবং তিনি টেকনাফ পৌরসভার কাইয়ুকখালী (৩ নম্বর ওয়ার্ড) এলাকার বাসিন্দা।

র‌্যাবের দেওয়া তথ্যে কাউন্সিলর একরামুলের বাবার নাম ও ঠিকানা না মেলায় অনেকে সন্দেহ করছে, প্রশাসনের কোনো ভুলে বন্দুকযুদ্ধের শিকার হলেন কি না তিনি?

এমন ভুলের পর টেনাফবাসীর মুখে মুখে এখন একটাই প্রশ্ন কী কারণে হত্যা করা হলো কাউন্সিলর একরামুলকে?

কোনো মামলাই নেই
কথিত বন্দুকযুদ্ধের পর র‌্যাব একরামুলকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও ইয়াবার শীর্ষ গডফাদার দাবি করে। দাবি করা হয়, তার বিরুদ্ধে থানায় মাদকসহ অসংখ্য মামলা রয়েছে।

কিন্তু পুলিশ বলছে ভিন্ন কথা। একরামুল ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত ছিলেন; এ ধরনের কোনো তথ্যই নেই পুলিশের কাছে।

টেকনাফ থানা পুলিশ জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে থানায় মাদকের কোনো মামলা নেই। এমনকি অন্য কোনো মামলাও নেই।

টেকনাফ থানার ওসি রনজিত কুমার বড়ুয়া চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ‘তার নামে থানায় কোনো মামলা নেই। অতীতে তার নামে একটা মামলা হয়েছিলো। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন।’

ঘটনার পর যা বলেছিল র‌্যাব
কথিত বন্দুকযুদ্ধের পর র‌্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মোঃ রুহুল আমিন সাংবাদিকদের বলেন, টেকনাফে ইয়াবা পাচারের খবর পেয়ে নোয়াখালী পাড়ায় এক ব্যক্তির গতিরোধ করে র‌্যাব।

‘ওইসময় র‌্যাবকে লক্ষ্য করে ওই ইয়াবা ব্যবসায়ী গুলি ছোড়ে। র‌্যাবও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান ওই ইয়াবা ব্যবসায়ী।’

তিনি আরো বলেন, সেসময় একটি বিদেশী পিস্তল, একটি ওয়ান শুটার গান, ৬ রাউন্ড গুলি এবং ১০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

কী বলছেন এলাকাবাসী?
একরামুল হকের নিকটাত্মীয়দের কেউ কেউ মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকলেও একরামুল নিজে কোনোভাবেই মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিলেন না বলে জানিয়েছন তার এলাকার লোকজন। শুধু তাই নয়, তাদের কাছে একরাম সৎ মানুষ হিসেবে পরিচিত।

একরামের সাদামাটা জীবন
জানা গেছে, একরামুল তিন বারের নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর। যুবলীগের অাগের কমিটিতে প্রায় ১২ বছর  ধরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করলেও তিনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। এমনকি বানাতে পারেননি নিজের জন্য একটি বাড়িও।

পৈতৃক সূত্রে পাওয়া টেকনাফের কাইয়ুকখালী পাড়ায় ৩ নং ওয়ার্ডে ছয় বছর ধরেও একটি বাড়ি নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারেনি অর্থের অভাবে। সামান্য এই জমিতে বাড়ির দেয়াল দিলেও দিতে পারেননি ছাদ।

একটি ঘরে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে বসবাস করতেন। তার দুই মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালাতেন একরামুলের ভাইয়েরা।

যা বলছেন টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান
একরামের নিহত হওয়ার ঘটনাকে বড় ভুল উল্লেখ করে টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম চ্যানেল আই অনলাইনকেবলেন: ‘আমি রোববার তাদের বাসায় গেছিলাম। তারা অত্যন্ত দরিদ্র। তার ঘরে একটা শোবার জন্য একটা ভালো খাটও নেই।

‘তার স্ত্রী আমাকে তাদের দুই মাসের বকেয়া বিদ্যুৎ বিল দেখিয়েছে। মাদক ব্যবসা করলে তার ঘরে কিছু না কিছু জিনিসপত্র থাকবেই। তার বাবাও বড় মানুষ ছিল, ভালো বংশ ছিল। কিন্তু এখন সে অনেক দরিদ্র জীবন-যাপন করে। সে মাদক ব্যবসায়ী ছিল না। আমার মনে হয় কোথাও কোন একটা ভুল হয়েছে।’

একরামুলের ভাইয়ের দাবি
এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না একরামুলের ভাই এহতেশামুল হক। তার দাবি, একরামকে  খুন করা হয়েছে।

কোনো সম্পত্তি ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন: ‘ও খুব কষ্ট করে জীবন-যাপন করতো। ৬ বছর অাগে ঘরের কাজে হাত দিয়েছিল। সেই ঘরের ছাদও দিতে পরেনি। আমার ভাই নিরীহ মানুষ ছিল।’

একরামুলর নামের সাথে তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীর নামের মিলের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন: ‘আমার ভাই আর তালিকাভুক্ত ব্যক্তির নাম এক। কিন্তু বাবার নাম ও গ্রামের নামে কোনো মিল নেই।’

বদি পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব?
স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির পরিবারের সাথে রাজনৈতিক সমস্যা রয়েছে কী না জানতে চাইলে এহতেশামুল বলেন, তার চাচা সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল গণির সাথে বর্তমান সংসদ সদস্য বদি পরিবারের অনেক আগে সমস্যা থাকলেও, বর্তমানে তাদের পরিবারের সাথে ও একরামুলের সাথে কোনো বিরোধ ছিল না বদি পরিবারের।

তবে এলাকার রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, একরামের পরিবার বদির পরিবারের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই পারিবারিকভাবে দ্বন্দ্বে লিপ্ত।

তালিকা নিয়ে অসন্তোষ
বিভিন্ন সময়ে মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা তালিকা ও পুলিশ প্রশাসনের তালিকা নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এলাকার মানুষ।

তারা বলছেন, তালিকায় ৯০ ভাগ মানুষের নাম সঠিক হলেও ১০ ভাগ একেবারেই নিরীহ মানুষ বলে দাবি করছেন তারা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য, ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরেও এলাকার অনেকের নাম উঠে আসছে বলে জানিয়েছেন তারা।

রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত এক ব্যক্তি বলেন: ‘একরামুল কখনোই ইয়াবার গডফাদার না। ইয়াবার গডফাদার হলে সে এত দরিদ্র হত না। সে নিরীহ মানুষ। অামার মনে হয় সে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।’

বিএনপি নেতাও বলছেন একরামুল সৎ
একরামুল হকের সাদামাটা জীবন-যাপনের বিষয়টি তুলে ধরে উপজেলা বিএনপির সভাপতি রাজ্জাক চ্যানেল আই অনলইনকেবলেন: ‘একরাম আমাদের বাড়ির কাছেই থাকতো। সে কোনোভাবেই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল না। দুটো মেয়ে নিয়ে এক ঘরে অনেক কষ্টে জীবন-যাপন করতো সে।’

আলোচনায় এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা
এ ঘটনার পর আলোচনায় উঠে এসেছে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার নাম। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে ২০০৮ সালে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকায় নাম এসেছিল কমিশনার একরামের। একটি মামলা হয়েছিল সে সময়।

সেই সূত্রেই ২০১০ সালে নাম ওঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের প্রথম তালিকাতেও। কিন্তু সেই গোয়েন্দা কর্মকর্তার বদলির পর সেটা সংশোধন হওয়ায় একরামুলের নাম বাদ পড়ে হালনাগাদ সব তালিকা থেকে।

মুক্তিযোদ্ধা পরিবার
জানা গেছে, পারিবারিকভাবেই একরামুল হক এবং তার পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। মুক্তিযুদ্ধে তার পরিবার এলাকায় সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছে। টেকনাফের প্রথম বনেদি মুসলিম শাসকও তার দাদা। তিনি টেকনাফ দমদমিয়া পাহাড় কেটে নিজের টাকায় মানুষের জন্য সড়ক তৈরি করেছিলেন।

সূত্রঃচ্যানেল আই