নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে; মোবাইল সুবিধা যখন দেশে আসে বা বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো যখন একে একে চালু হতে শুরু করলো, তখনও বিদেশ থেকে টেকনেশিয়ান আমদানি করে তা চালানো হতো। কিন্তু আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রযুক্তিতে আর পিছিয়ে নেই।
দেশ যখন প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ দেখার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে কোটি মানুষ, তখন গাজীপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর নিয়ন্ত্রণ নিতে অপেক্ষা করছেন বাংলাদেশি ১৮ তরুণ।
বাংলাদেশ থেকে স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণে গত বছর গঠন করা হয় বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএসসিএল)। গত এক বছরে বিসিএসসিএল সারাদেশ থেকে জোগাড় করেছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ পরিচালনায় দক্ষ ৩০ তরুণকে। বিসিএসসিএলের অপারেশন ইউনিটে নিয়োগ পাওয়া ১৮ তরুণ দু’ভাগে গাজীপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ার গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে পরিচালনা করবেন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। বাকি ১২ জন থাকবেন গ্রাউন্ড স্টেশনের সিভিল ও ইঞ্জিনিয়ারিং সাইটে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ জানান, অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এসব মেধাবী তরুণকে খুঁজে আনা হয়েছে। লিখিত থেকে ভাইভা বোর্ডে ছিল দারুণ কড়াকড়ি। এসব তুরুণ গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে স্যাটেলাইট নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়া গ্রাউন্ড স্টেশনের প্রজেক্ট ম্যানেজার শিপন চন্দ্র হালদার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিভিন্ন মেয়াদে বাংলাদেশের ৩০ মেধাবী তরুণ ইঞ্জিনিয়ারকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস। এ লক্ষ্যে তাদের ফ্রান্সে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া থ্যালেস অ্যালেনিয়ার কর্মকর্তারা দুই গ্রাউন্ড স্টেশনে শুরু থেকেই বাংলাদেশি তরুণদের নিয়ে কাজ করছেন। গত কিছুদিন ধরে থ্যালেস অ্যালেনিয়ার কর্মকর্তারা বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের নিয়ে নিয়মিত ওয়ার্কসপও করছেন।’
গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশনের ব্যবস্থাপক ও স্যাটেলাইট প্রকৌশলী নাসির উদ্দির বনি বলেন, ‘স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণ থাকবে আমাদের হাতেই। স্যাটেলাইট উন্মুক্ত হওয়ার পরপর এর নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও কোরিয়ার তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনে চলে যাবে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের তিন মাসের মধ্যে এর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেবে বাংলাদেশ।’
স্যাটেলাইট নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, উপগ্রহটি ১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের কক্ষপথে পৌঁছানোর জন্য সাতদিন সময় লাগবে। কয়েক দিন ধরে পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর উপগ্রহটিকে পর্যায়ক্রমে বেতবুনিয়া ও গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে।
বেতবুনিয়ায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন নিয়োজিত একাধিক প্রকৌশলী জানান, উৎক্ষেপণ স্থান থেকে ৩৬ হাজার ৭০০ কিলোমিটার যাওয়ার পর রকেটের স্টেজ-২ খুলে যাবে। এ জন্য সাত থেকে ১০ দিন সময় লাগবে। স্যাটেলাইট উন্মুক্ত হওয়ার পরপর এর নিয়ন্ত্রণ নেবে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও কোরিয়ার তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশন। এরপর থেকে সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে ওই তিন গ্রাউন্ড স্টেশন স্যাটেলাইটকে তার কক্ষপথে সেট করবে। এর সাতদিন পর বাংলাদেশের পক্ষে স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণ নেবে গাজীপুর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন। এর মাঝেই চলতে থাকবে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এ পক্রিয়া শেষ হতে ২০ দিন সময় লাগবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ বিষয়ক সংস্থা ‘স্পেসএক্স’ এর ফ্যালকন-৯ রকেট ফ্লোরিডার কেইপ কেনাভেরালের লঞ্চপ্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে নিয়ে মহাকাশের দিকে উড়াল দেবে। দুটি ধাপে এ উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া শেষ হবে। লঞ্চঅ্যান্ড আরলি অরবিট ফেইজ (এলইওপি) এবং স্যাটেলাইট ইন অরবিট। এলইওপি ধাপে ১০ দিন এবং পরের ধাপে ২০ দিন সময় লাগবে।
উৎক্ষেপণ স্থান থেকে ৩৬ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দূরে যাবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সিংটেলের কান্ট্রি ম্যানেজার কাজী হাফিজ আল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘গ্রাউন্ড স্টেশন পরিচালনার জন্য দক্ষ জনশক্তি বাংলাদেশে ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। যদিও আগামী প্রথম তিন মাস সরাসরি এবং পরের তিন বছর আমাদের পেছন থেকে থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণ করবে। এটি হবে তিনটি ধাপে। প্রথম ধাপে আমাদের ছেলেরা ওদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি শিখবে, পরের ধাপে সমানে সমান, অর্থাৎ ওরা একটা পরিচালনা করলে আমরা অন্যটা করবো, শেষ ধাপে বাংলাদেশি তরুণ বিজ্ঞানীরা দুটো গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ বুঝে নেবে। তবে পেছন থেকে সাহয্য করবে থ্যালেসের বিজ্ঞানীরা। তিন বছর পর পুরোপুরি অর্থাৎ এককভাবে নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের হাতে চলে আসবে।’
নাম না প্রকাশের শর্তে একাধিক প্রকৌশলী বলেন, ‘আমরা এখন থেকেই স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রস্তুত। মূলত আমরা সামনে থেকেই স্যাটেলাইটটি পরিচালনা করবো, বিদেশি বিজ্ঞানীরা পেছন থেকে আমাদের সহায়তা করবেন। গত দেড় বছরে বারবার বিষয়গুলো আমরা চর্চা করেছি। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে শুধু ওই বিষয়ে কাজ করছি।’
তারা বলেন, ‘বর্তমানে ছয়জন প্রকৌশলী বেতবুনিয়া গ্রাউন্ড স্টেশনের কাজের দেখভাল করছেন। এছাড়া অপারেশন ইউনিটের সবাই ঢাকার গাজীপুরে অবস্থান করছেন। স্যাটেলাইট সফলভাবে উৎক্ষেপণের পর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে থ্যালেসের হাতে প্রশিক্ষিত প্রকৌশলীরা কে কোথায় দায়িত্ব পালন করবেন। দুই কন্ট্রোল স্টেশনে মূল অপারেশনে কাজ করবেন ১৮ জন।’
এ প্রসঙ্গে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘স্যাটেলাইট থাকবে মহাকাশে। তবে তার যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ হবে দেশের দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে। উপগ্রহটি ১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের কক্ষপথে (অরবিটে) ধরে রাখার কাজটি করবে গ্রাউন্ড স্টেশন। তবে উপগ্রহটি তার জায়গা থেকে মাঝে মাঝে সরে যেতে পারে। সেখানে আমাদের একটি ৭৫ কিলোমিটার জায়গা আছে। এর মধ্যে স্যাটেলাইটটিকে রাখতে হবে। কাজটিই এখান থেকেই করা হবে।’
‘এছাড়া স্যাটেলাইটের যাবতীয় মেইনটেন্যান্স কাজ দুই গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে করা হবে।’
স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘এটা তো আমাদের জন্য প্রথম অভিজ্ঞতা। স্বাভাবিকভাবেই এখন বিদেশি প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশি লোকবল আমাদের লাগবে। তবে আমরাও চাই এর শতভাগ যেন আমাদের আয়ত্তের মধ্যেই থাকে।’
‘অন্য কারো ওপর যেন নির্ভরশীল হতে না হয় সে চেষ্টা আমাদের রয়েছে। আগামী তিন বছর বিদেশি প্রতিষ্ঠান এবং তাদের জনবলের সঙ্গে আমাদের চুক্তি রয়েছে। তো সে পর্যন্ত তারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন’- যোগ করেন মন্ত্রী।