কাজের জীবন বনাম অবসরের জীবন

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

কাজ থেকে বাদ গেলে বা কোনো কাজে নিজেকে নিয়োজিত না রাখলে আমরা বলি অবসরের জীবন। অবসর আর বেকার জীবনের মধ্যে পার্থক্য আছে। অবসর হল বয়সের পরের জীবন, যে জীবনে মানুষ কর্মক্ষমতা হারায়। কেউ নিজে কর্মক্ষমতা হারিয়েছে মনে না করলেও সমাজ ও রাষ্ট্র মনে করে, এত বছর বয়সের পর একটা লোক সাধারণ কর্মক্ষমতা হারায় এবং তারা তাকে কিছু অর্থকড়ি দিয়ে অবসরে বা বিনা কাজের জীবনে পাঠিয়ে দেয়। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মনে করে একজন শিক্ষকের ৬৫ বছর হয়ে গেলে তার মাথা থেকে আগের মতো ভালো জ্ঞান বের হবে না। ছাত্ররা তার কাছ থেকে নতুন কিছু শিখতে পারবে না। শিক্ষকটি গবেষণার জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছেন। তাই তাকে কাজ থেকে ছুটি দেয়া হয়।

সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে বয়সের বাধা নেই। তবে সেক্ষেত্রেও নিয়োগকর্তা দেখে তার কলম থেকে আগের মতো শাণিত কিছু বের হয় কিনা। বের না হলে তাকেও কিছু বাড়তি অর্থকড়ি দিয়ে বিদায় করা হয়। ব্যক্তি খাতের কাজের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ব্যাংকের সিইও’র ক্ষেত্রে দেখা হয় তার নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা অটুট আছে কিনা। তার ধ্যান-ধারণা থেকে ব্যাংক নতুন কিছু পাবে কিনা। এক্ষেত্রেও একটা বয়সের পর তাকে বিদায় করা হয়। আমলাতন্ত্রের ক্ষেত্রেও তাই। কর্মক্ষমতা লোপ পেতে শুরু করলে একটা বয়সের পর তাকেও চাকরিতে রাখা হয় না।

যারা চাকরি করে অবসরে গেছেন তাদের বেকার বলা যাবে না। বেকার হল ওরাই যাদের বয়স আছে, কিন্তু আর্থিক মূল্যের কোনো কাজ তারা করে না। আর্থিক মূল্যটা কাজে আছে কী নেই, তা থেকেই বিবেচিত হয় কাজ থেকে কোনো মজুরি, বেতন-ভাতা ইত্যাদি আসছে কিনা, যার ভিত্তিতে ধরা হয় লোকটি বেকার না কর্মে নিয়োজিত। অর্থনীতি শাস্ত্রে বিনামূল্যের কাজ বা যে কাজের বিপরীতে অর্থ পাওয়া যায় না এমন কাজকে কাজ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। তাই একজন বয়স্ক ব্যক্তি যদি তার ঘরে অনেক কাজও করেন, বা তার নাতি-নাতনিদের অনেক স্নেহ-ভালোবাসা দেন- এটাকে অর্থনীতি শাস্ত্র কাজ বলে স্বীকৃতি দেয় না। আর এই বিবেচনায় এসব কাজের মূল্যায়ন করা বা স্বীকৃতি দেয়া হয় না বলে আমাদের জিডিপি বা মোট দেশজ আয়ে এসব কাজকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। শুধু কাজের ভিত্তিতে কোনোদিন যদি জিডিপির হিসাব করা শুরু হতো, তাহলে স্নেহ-ভালোবাসার মতো কাজগুলোও জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হতো। আর তখন যে সমাজে যত স্নেহ-ভালোবাসা (Affection and love) আছে, সেই সমাজের জিডিপির আকার তত বড় হতো! কিন্তু এসব অর্থনীতি শাস্ত্রে প্রবেশ করতে পারেনি বলে দেশে দেশে এই গুণগুলোর কোনো মূল্যায়ন হয় না। অর্থনীতি আমাদের শিখিয়েছে, কোনো কিছুর মূল্য থাকলে তার বাজারমূল্য থাকতে হবে। অর্থাৎ স্নেহ-ভালোবাসা এসবের বাজারমূল্য থাকতে হবে। তবেই তো এসব বিষয় আমাদের জাতীয় আয় গণনায় ভালোভাবে অন্তর্ভুক্ত হতো। সূর্যের আলো, চাঁদের কিরণ কিংবা পাহাড়ের সৌন্দর্যকেও জাতীয় আয় হিসেবে গণ্য করা হয় না। কারণ হল, এসবের বাজারমূল্য নেই। বাজারে এনে এসবকে যদি বেচাকেনা যেত তাহলে যে দেশে সূর্যের আলো বেশি, যে দেশে চাঁদের মোলায়েম আভা বেশি, সেদেশের জাতীয় আয় অনেক বড় হতো। মানুষের ভালো স্বাস্থ্যকেও জাতীয় আয়ের গণনায় আনা হয় না। গণনা তখনই হয়- ভালো স্বাস্থ্য ব্যবহার করে তারা যদি কিছু উৎপাদন করে তা বাজারে বিক্রি করতে পারে।

যা হোক, বলছিলাম অবসরের জীবন নিয়ে। অনেক ব্যক্তি প্রকৃতঅর্থে বয়সকালেও কর্মক্ষম থাকে; কিন্তু বয়সের একটা নিয়ম অনুযায়ী তাকেও অবসরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমাদের অনেক অধ্যাপক আছেন, যাদের স্বাস্থ্য ও কর্মক্ষমতা ভালোই ছিল; কিন্তু সেই নিয়ম অনুযায়ী তাদেরও অবসরে যেতে হয়েছে। অন্যদিকে বয়স আছে, কিন্তু রুগ্ন ও কর্মক্ষমতার দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে যারা, তারাও কাজে বা চাকরিতে আছে। এটা এ কারণেই হচ্ছে যে, বয়সের ক্ষেত্রে পার্থক্য করে তাদের অবসরে পাঠালে অন্যায় হবে, স্বজনপ্রীতি হবে। তাই একটাই নিয়ম- আপনার স্বাস্থ্যের অবস্থা যা-ই থাকুক না কেন, ৬৫ বছরের পরে অবসরে যাবেন। সেটাই ভালো। তবে কিছু অধ্যাপক আছেন, যারা অনেক বয়সেও চাকরিতে অর্থাৎ পূর্ণ বেতনের কাজে নিয়োজিত আছেন। তাদের ক্ষেত্রে যুক্তি হল- এটা তাদের জাতীয় স্বীকৃতি। তাদের পড়াতে হবে না। দু’একটা বক্তৃতা দিয়ে জ্ঞানগর্ভ কিছু বললেই এর মূল্য অমূল্যের মতো কিছু হবে। এমন কিছু শিক্ষক বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখা যায়। তারা আসেন, বসেন, মাঝে-মধ্যে পাবলিক লেকচার দেন। তাদের পদবি একেকজনের একক রকম। তবে তারা সবাই একসময়ের ডিসটিনগুইশ্ড (Distinguished) প্রফেসর। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকার হবে ভেবে তাদের ভিন্নভাবে পো-রোলে রাখা হয়।

যারা অবসরে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যেও অনেকে কাজকে ছাড়তে চান না। অন্যকিছু কাজ করতে চান, হয় ফুলটাইম নতুবা পার্টটাইম। আবার কেউ কেউ যান পূর্ণ অবসরে। তারা বেতন-ভাতার কোনো কাজই করেন না। হয়তো তারা সেটা পারেনও না। কিন্তু যারা ফুল বা পার্টটাইম কাজে লেগে যান, তারাও একসময়ে ওসব কাজ থেকে পূর্ণ অবসরে চলে যান। তখন তার শরীরটা আর কাজ করতে চায় না। মন, শরীর ইত্যাদি বয়সের কাছে পরাজিত হয়। হতে বাধ্য। এটাই হল সবার নিয়তি। এক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নেই। শুধু একটু আগে অথবা একটু পরে। একসময়ে মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তি কমে যায়। এ সময় মানুষ অনেক কিছু ভুলে যায়। শরীরের সেলগুলো মরে যেতে শুরু করে। হাসপাতাল, ডাক্তারের চেম্বার ইত্যাদি জায়গায় দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। যদিও হাসপাতাল, ওষুধ, ডাক্তার- এসব তাদের হারিয়ে যাওয়া জীবনকে কখনও ফিরিয়ে দিতে পারবে না। তারপরও তারা এসবের কাছে যায়। পরিবারের লোকজন তাদের নিয়ে যায়। বৃদ্ধ বয়সে হাসপাতালে গিয়ে কেউ উন্নত শরীর নিয়ে ফিরে এসেছে এমন উদাহরণ খুবই কম। আমাদের দোষ হল, আমরা মানতে পারি না যে আমাদের দিনগুলো শেষ হয়ে এসেছে, যেভাবে শেষ হয়ে গিয়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবন।

হাসপাতালে গেলে দেখবেন আপনার, আমার বয়সের অনেক মানুষ হয় ডাক্তারের জন্য, নয়তো রক্ত পরীক্ষা করানোর জন্য, অথবা কেমিয়ো-ডায়ালাইসিস ইত্যাদি ধরনের চিকিৎসা নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। এ চিকিৎসায় কেউ সুস্থ হবেন, কেউ হবেন না। তবুও আরেকটি সুযোগ নেয়ার জন্য তারা হাসপাতালে এসেছেন। তবে জীবন চলে যাবে। অনেকের ক্ষেত্রে মেসেজ এসে গেছে। কিন্তু সত্য হল, অনেকে মেসেজটা পড়তে পারেন না। পড়তে পারলে ভালো হতো। দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা থেকে অনেকটা মুক্ত থাকা যেত। শরীর একটা পর্যায়ে ভেঙে পড়বেই। এটাই সৃষ্টিকর্তা আমাদের স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন। আমরা দুর্বল ছিলাম, তারপর তিনি সবল করেছেন, তারপর আমরা বৃদ্ধ হয়ে গেছি। এর অর্থ হল, আমাদের এ দুনিয়া ত্যাগের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। যারা নিতে পেরেছে তারা সৌভাগ্যবান। আমাদের জীবন, আমাদের শান্তি- সবই আল্লাহর দান। আমরা যদি সবাই আল্লাহকে স্মরণে রাখতে পারি, তাহলে অনেক দুঃখবোধ থেকে মুক্ত থাকব।

আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ