সাইফুল ইসলাম : দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টানা দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শপথ নিয়েছেন অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ। নির্বাচিত হয়ে কোনো ধরনের বিতর্ক ছাড়া প্রথম মেয়াদ পার করে দ্বিতীয় মেয়াদে পুনর্নির্বাচিত হওয়া বাংলাদেশে কোনো রাষ্ট্রপতির বেলায় এই প্রথম। কেবল মানুষের ভালোবাসাই একজন মানুষকে সফলতার শিখরে পৌঁছে দিতে পারে।
বিশেষ করে রাজনীতিকে ক্যারিয়ার হিসেবে যারা নেন, তাদের ক্ষেত্রে কথাটা বেশি প্রযোজ্য। এজন্য দরকার আন্তরিকতা, জনসেবা ও মানুষকে মন থেকে ভালোবাসার ব্রত নেয়া। দেশসেরা নামিদামি প্রতিষ্ঠানের বড় ডিগ্রি, আকর্ষণীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরি এক্ষেত্রে বড় কোনো বিষয় নয়। বড় বিষয় সততা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৪৪ সালের পহেলা জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে জন্ম নেয়া মো. আবদুল হামিদ স্থানীয় নিকলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, গুরুদয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রি পাস করেন। তারপর আইন বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে কিশোরগঞ্জেই আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
লক্ষণীয় বিষয়, তিনি দেশের সেরা কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেননি, এমনকি নামিদামি কোনো স্থানে ক্যারিয়ারও গড়েননি। তারপরও সাতবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোর মাত্র দুটি ছাড়া সবক’টিতেই তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন। এটি সম্ভব হয়েছে তার সততা, আন্তরিকতা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে। ১৯৭৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি জিততে পারেননি আর ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেনি। তিনি জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকারের দায়িত্বও পালন করেছেন দীর্ঘদিন। নবম সংসদে তিনি যখন স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের অসুস্থতার কারণে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান। এরপর তিনি স্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। স্পিকার থাকাকালীন তিনি যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তা দেশবাসী কর্তৃক বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তার প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসামান্য রসবোধ। এ রসবোধ সংসদকে প্রাণবন্ত করে রেখেছিল। নিরপেক্ষতার প্রশ্নেও তিনি ছিলেন বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তার সম্পর্কে অনেক কথাই বলা যায়, সংক্ষেপে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সজ্জন হিসেবে তিনি এক আদরণীয় ব্যক্তিত্ব।
রাষ্ট্রপতির মতো গুরুদায়িত্বের প্রথম মেয়াদে যেভাবে প্রজ্ঞা ও দক্ষতার সঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন, দ্বিতীয় মেয়াদেও সেভাবে তিনি দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবেন, আমরা এমনটিই আশা করি। আমাদের মতো পারস্পরিক অবিশ্বাসের দেশে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ও রাজনৈতিক বিপর্যয় নেসে আসা অস্বাভাবিক নয়। এক্ষেত্রে আপাদমস্তক রাজনীতিক একজন রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালন করলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া অনেকটা সহজ হয়ে যায়।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের মধ্যে আছে অসামান্য রসবোধ, মানুষকে হাসিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার অন্যরকম ক্ষমতা। বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে যখন রাষ্ট্রপতিকে কেবল লিখিত বক্তব্য পাঠ করতে হয়, তখন তিনি বক্তব্যের মাঝে বিরতি দিয়ে নিজ থেকে কৌতুক করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং দর্শক-শ্রোতাদের সজীব ও প্রাণবন্ত করে তোলার চেষ্টা করেন। মনে পড়ে, ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে উপস্থিত আমরা যখন তীব্র গরমে ক্লান্ত-শ্রান্ত, তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য লিখিত বক্তব্য থামিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, জানি আপনাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমার হাত-পা বাঁধা। যেভাবে বক্তব্য লিখে দেয়া হয়, সেভাবে পড়তে হয়। তবে এসব আমার ভালো লাগে না। আপনারা একটু ধৈর্য ধরে শুনুন। কারণ এটিই মনে হয় আমার শেষ বক্তব্য। আর নাও বাঁচতে পারি। কারণ আমার আগে গত বছর যিনি এ সমাবর্তনে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি আজ বেঁচে নেই…। তার আরও কিছু রসাÍক কথাবার্তায় গোটা সমাবর্তনস্থল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মমতা ও আন্তরিকতার পাশাপাশি হাস্য-রসাত্মক মনোভাব কিন্তু একজন রাজনীতিকের অন্যতম গুণ। আমাদের দেশের বেশিরভাগ রাজনীতিকের মুখের দিকে তাকালে মনে হয় তাদের ওপর বজ পাত হয়েছে। অথচ হিউমার বা হাস্যরসবোধ একজন রাজনীতিকের অন্যতম সম্পদ। পশ্চিমা দেশগুলোর প্রায় সব রাজনীতিককেই কৌতুক করতে দেখা যায়। এতে করে তারা মানুষের আরও কাছে যেতে পারেন। তাদের মনোভাব বুঝতে ও সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হন। রাষ্ট্রপতির অন্যান্য গুণের পাশাপাশি কৌতুকের এ গুণ আমাদের রাজনীতিক এবং ভবিষ্যতে যারা রাজনীতি করতে চান তাদের জন্য শিক্ষণীয়।
রাষ্ট্রপতির আরেকটি ভালো গুণ হল রাষ্ট্রপ্রধানের মতো গুরুদায়িত্ব পালনের পরও তিনি সময় পেলেই নিজের এলাকায় ছুটে যান। মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেন এবং নৌকা ও রিকশার মতো আরামদায়ক বাহনে চড়া এবং মানুষের খোঁজখবর নেয়ার সুযোগটি হাতছাড়া করতে চান না। গত মেয়াদে এমন ঘটনা আমরা অনেকবার দেখেছি। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে আশা করা যায়।
বছরের পর বছর মানুষের মন জয় করে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে থাকার অনন্য নজির গড়ায় এলাকার মানুষ ভালোবেসে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে ‘ভাটির শার্দূল’ বলে থাকেন। দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি যেন সুস্থ ও সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন এবং দীর্ঘদিন জাতি তাকে অভিভাবক হিসেবে পেতে পারে- এটাই আমাদের চাওয়া। অভিনন্দন ‘ভাটির শার্দূল’।
সাইফুল ইসলাম : সাংবাদিক
saifulh92@gmail.com