বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে শিক্ষক ও কর্মকর্তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ডীন ও সিন্ডিকেট সদস্য ড. হাসিনুর রহমানের টেলিফোন হিসাব শাখার কর্মকর্তা বরুন কুমার রিসিভ না করাকে কেন্দ্র করে এ দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। এ দ্বন্দ্বের ঘটনা বিশ্ববিদ্যায় ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে। মন্তব্য পাল্টা মন্তব্যে সরগরম ফেসবুক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও বিচার দাবীতে আল্টিমেটাম দিয়েছেন।
এ ঘটনায় পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ দয়ের করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে। এ ঘটনা নিয়ে কর্মকর্তারাও নিজেদের মধ্যে সভা করেছেন। তারাও পাল্টা অভিযোগ তুলে শিক্ষককে এ ঘটনার জন্য ভুল স্বীকার করার দাবী তুলেছেন সভায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ডীন ড. হাসিনুর রহমানকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব শাখার সহকারী পরিচালক বরুন কুমার দে’র সাথে ওই শিক্ষকের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তাকে লাঞ্ছিত করা হয়।
এ ঘটনার বিচার চেয়ে ওই শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতি বরাবর একটি আবেদন করেছেন। এর পরপরই বৃহস্পতিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব শাখার অপর এক সহকারী পরিচালক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার নিজের ভেরিফাইড একাউন্ট থেকে শিক্ষকদের নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। অপরদিকে রাতে বিশ্ববিদ্যলয় শিক্ষক সমিতি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ড. মোঃ হাসিনুর রহমান এর সাথে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দপ্তর বিভাগের সহকারী পরিচালক বরুন কুমার দে এর বিরুদ্ধে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রেরণ করেন পত্রিকা অফিসে।
শিক্ষক নেতৃবৃন্দ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষকের সাথে চরম দুর্ব্যবহার, অশালীন মন্তব্য, চাকুরিবিধি বহির্ভূত ও অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগে তুলে কর্মকর্তা বরুন কুমার দে’র বিচার দাবী করেছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা পৃথক কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ জানান-গতকাল শনিবার অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় আলোচনা করার কথা থাকলেও তা না হওয়ায় আজ রবিবার সাধারণ সভা আহ্বান করেছে শিক্ষকরা। সেখান থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার কথা রয়েছে।
ঘটনার শিকার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ডীন, মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞানের চেয়ারম্যান, ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শ কেন্দ্রের পরিচালক এবং সিন্ডকেট সদস্য ড. হাসিনুর রহমান এর সাথে কথা বলে এবং তার দেয়া অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি অর্থ ও হিসাব শাখার সহকরী পরিচালক বরুন কুমার দে’র সেলফোনে অফিসের কাজের জন্য বেশ কয়েকবার ফোন দেন। কিন্তু তিনি তা রিসিভ করেননি এবং পরবর্তীতে ফোনও করেননি। এ কারনে তিনি দুপুর তিনটায় তার দপ্তরে যান। সেখানে যাওয়ার পরে বরুন কুমার দে তার কক্ষে গিয়ে কথা বলার কথা বলেন। বরুন কুমার দে এক ঘন্টা পরে ড. হাসিনুর রহমানের কক্ষে গেলে তার কাছে ফোন রিসিভ না করা এবং পরবর্তীতে ফোন না করার কারন জানতে চাওয়া হলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে যান। শিক্ষকের অধীনস্থ নয় এমনটি দাবি করে বরুন কুমার দে অশ্লীল ব্যাবহার করতে থাকেন বলে অভিযোগ শিক্ষকদের।
তারা আরও দাবী করেন বিষয়টি উপাচার্য মহোদয়কে অবহিত করার কথা বললে বরুন কুমার দে ওই শিক্ষককে লাঞ্ছিত করেন। এ সময় ওই শিক্ষকের কক্ষে অবস্থান নেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো.আলাউদ্দিন, কোস্টাল স্টাডিজ এন্ড ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ড. হাফিজ আশরাফুল হকও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. খোর্শেদ আলম ওই কর্মকর্তাকে নিবৃত করেছেন বলে জানান এক শিক্ষক নেতা। তবে এ বিষয়ে অর্থ ও হিসাব শাখার সহকরী পরিচালক বরুন কুমার দে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা রয়েছে অফিসিয়াল কাজ বহির্ভূত কোন ফোন রিসিভ না করার। এছাড়া ভিসি এবং ট্রেজার এর কক্ষে বসে ফোন রিসিভ না করারও নির্দেশনা রয়েছে। তাই আমি ফোন রিসিভ করিনি। পরে আমি ওই শিক্ষকের কক্ষে গিয়ে ফোন দেয়ার কারন জানতে চেয়েছি। তখন ফোন রিসিভ না করার বিষয়টি নিয়ে তিনি উত্তেজিত হয়ে যান এবং আমাকে অনেক বকাঝকা করেন। আমি বিষয়টি রেজিস্ট্রারকে অবহিত করেছি। তিনি ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুই দফা সভা করেছে। সভায় কর্মকর্তার সাথে শিক্ষকের দুর্বব্যবহারের অভিযোগ তুলে ওই শিক্ষককে ভুল স্বীকার করে নিতে হবে দাবী তুলেন তারা। অন্যথায় পরবর্র্তী কর্মসূচি দেয়া হবে কলে তারাও হুশিয়ারি দিয়েছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা ফেসবুক আইডিতে শিক্ষকদের নিয়ে একটি পোস্ট করেন। তাতে উলে¬খ করেন” শিক্ষককরা কি আমাদের সকলকে তাদের ছাত্র মনে করেন? এটা কি তাদের বোঝার ভুল নাকি জ্ঞানের অভাব”। ওই পোস্টটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা শিক্ষকদের নিয়ে মন্তব্য করেন। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষকরা। তাই শুক্রবার তাৎক্ষণিক এসকল বিষয় নিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটি একটি জরুরী সভায় মিলিত হন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর মিয়া বলেন, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ডীন ড. হাসিনুর রহমান একজন জেষ্ঠ্য ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। তাকে লাঞ্ছিত করেছেন অর্থ ও হিসাব দপ্তরের সহকারী পরিচালক বরুন কুমার দে। একই সাথে ওই শিক্ষককে হুমকিও দিয়েছেন তিনি। ড.হাসিনুর রহমান আমাদের কাছে এ ঘটনা বর্ণনা করে সুষ্ঠু বিচার দাবী করে একটি লিখিত আবেদন দিয়েছেন। অভিযোগ পাওয়ার পরে শুক্রবার বিকালে কার্যনির্বাহী কমিটির সভা করেছি। এরপর ওই অভিযোগ পত্র আমরা উপাচার্যকে দিয়েছি। সিন্ডিকেটে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার কথা থাকলেও তা হয়নি। তাই আজ রবিবার শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভা আহবান করা হয়েছে। সেখানে সাধারণ শিক্ষকদের মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তী কর্মসূচি দেয়া হবে।
আবু জাফর মিয়া বলেন, অর্থ ও হিসাব দপ্তরের কর্মকর্তারা প্রায়ই শিক্ষকদের অসম্মান করে কথা বলেন। সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষকদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে পোস্ট দেন। আমরা এ বিষয়গুলোকেও উপাচার্য মহোদয়কে জানিয়েছি। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলাম প্রথমে বিষয়টি জানেন না বললেও পরবর্তীতে বলেন, এটা নিজেদের আভ্যন্তরীণ বিষয়। সকলে মিলে মিমাংসা করে নিলেই হয়। আর সিন্ডিকেট সভায় এ বিষয় নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। কারন বিষয়টি সিন্ডিকেটে তোলার মতই ছিলোনা। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় নিয়ে কোন মন্তব্য করাটা চাকুরিবিধি পরিপন্থী। যদি এটা কেউ করে থাকে তবে প্রমান সাপেক্ষে ব্যাবস্থা নেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম ইমামুল হক শিক্ষদের বলেন, আমি অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করা হবে। এর পরে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এ ঘটনাটি সিন্ডিকেটে তোলার বিষয় ছিলোনা তাই আলোচনা হয়নি বলে জানান।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার পত্রিকা অফিসে প্রেরিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ্ করেন, শিক্ষক ড. মোঃ হাসিনুর রহমান এর সাথে দুর্ব্যবহারের বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দপ্তর বিভাগের সহকারী পরিচালক বরুন কুমার দে। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো উলে¬খ রয়েছে, শিক্ষক ড. মোঃ হসিনুর রহমান এর সাথে চরম দুর্ব্যবহার, অশালীন মন্তব্য, চাকুরীবিধি বহির্ভূত ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সম্পাদক আবু জাফর মিয়া ও সভাপতি মোঃ ইব্রাহিম মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে। শিক্ষকের সাথে অমার্জনীয় আচরনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তৎপরবর্তী সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার দাবি করেন করেন শিক্ষক নেতারা।