সামনে আদালত, পেছনে সেনাবাহিনী

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের আশঙ্কাই সত্যি হলো। দেশটির সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে রাষ্ট্রীয় যে কোনো পদের জন্য আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। শুধু তাই নয়, আজীবন নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবেন না তিনি। যদিও দেশটিতে তাঁর দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন) এখনো ক্ষমতাসীন।

পাকিস্তানের ইতিহাসে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত দুটি সরকার টানা তাদের মেয়াদ শেষ করতে যাচ্ছে। ৭১ বছর বয়সী দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঘটতে যাচ্ছে এই ঘটনা। তবে দেশটির ইতিহাসের ব্যতিক্রমী এই ঘটনার ইতি টানতে নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগ। আর সেটাও যেন ঘোষণা দিয়েই!

ইতিহাস বলে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক যাত্রায় বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সামরিক বাহিনী। দেশটির প্রায় ৭১ বছরের বেশির ভাগ সময় কেটেছে সামরিক উর্দি পরা এক নায়কদের হাতে। কখনো কখনো সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অভিযোগের আঙুল উঠেছে বিচার বিভাগের দিকেও। বিচার বিভাগের সাম্প্রতিক ভূমিকাও এমন অভিযোগের পক্ষেই কথা বলছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি সাকিব নিসার যেন চলমান গণতান্ত্রিক যাত্রায় ছেদ টানতে ‘গ্রাউন্ড’ তৈরির কাজ করছেন।

তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, মেয়াদ শেষ করতে পারেননি কোনোবারই। ছবি: রয়টার্স

৭১ বছর বয়সী পাকিস্তানে এ পর্যন্ত ২৮ প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন। কোনো প্রধানমন্ত্রীই তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। সর্বশেষ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে আদালতের নির্দেশে চলে যেতে হয়। গত জুলাইয়ে আদালতের নির্দেশে নওয়াজকে যে শুধু প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়তে হয়েছে, তা নয়—তাঁকে তাঁর দলের (পিএমএল-এন) প্রধানের পদও ছেড়ে দিতে হয়েছে। আর শুক্রবার প্রধান বিচারপতি সাকিব নিসারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ চূড়ান্ত রায়ে নওয়াজকে আজীবন রাষ্ট্রীয় কোনো পদের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করেছেন। পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্যও তাঁকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

দুর্নীতি বা অন্য যে কোনো কারণে কেউ অপরাধী সাব্যস্ত হলেও পাকিস্তানের সংবিধান কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সংগঠন করার অধিকার দিয়েছে। আদালত যখন কোনো ব্যক্তির দলীয় প্রধান পদে থাকা না থাকার সিদ্ধান্ত দেয়, তখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, দলীয় প্রধানও ঠিক করে দেবেন আদালত? পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী নওয়াজের কিন্তু তাঁর দলীয় প্রধানের পদে থাকতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। আদালত তাঁকে সেই পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়ায় নওয়াজ, তাঁর দল বা শুভাকাঙ্ক্ষীরা আশঙ্কা করছিলেন, আজীবন নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছেন তিনি। এখন সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো।

চূড়ান্ত রায়ের পর নওয়াজের ভাই ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেছেন, ‘নওয়াজ শুধু একজন ব্যক্তির নাম নয়। নওয়াজ একটি দর্শনের নাম। দলকে পথনির্দেশনা দিতে বা জনগণের সেবা করতে নওয়াজের কোনো রাষ্ট্রীয় পদে থাকার দরকার নেই।’ পাকিস্তানের আরেক বড় দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। দলটির জ্যেষ্ঠ নেতা সৈয়দ খুরশিদ শাহ বলেছেন, ‘এই রায় সর্বোচ্চ আদালত থেকেই এসেছে। সংবিধান ও আইন সুস্পষ্টভাবে নওয়াজ শরিফকে শাস্তি দিয়েছেন। কিন্তু পিপিপি বিশ্বাস করে পার্লামেন্টই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী।

পাকিস্তানের পার্লামেন্ট ভবন

আপাতদৃষ্টিতে বিচার বিভাগের কাছ থেকেই এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এসেছে। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘ভালো চরিত্রের নেতা’ জনগণের প্রাপ্য। সম্প্রতি এই প্রধান বিচারপতি যেন পাকিস্তানিদের জন্য ‘বিশুদ্ধ পানি, বাতাস আর খাঁটি দুধ’ নিশ্চিত করার মিশনে নেমেছেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন একটি বেঞ্চে জনস্বার্থের নয়টি মামলা রয়েছে।
চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি ৩০ টি স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) মামলার নির্দেশ দেন। যার মধ্যে একটি ছিল একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী তাঁর পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় ফি দিতে পাচ্ছেন না। প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সেই অর্থ দেবেন। আরেকটি স্বতঃপ্রণোদিত মামলায় প্রধান বিচারপতি গুণগতমানসম্পন্ন মুরগির খাবার নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন।

যে দেশের আদালতে ৩০ লাখ মামলা বিচারাধীন, সে দেশের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে এ ধরনের মামলা কিছুটা অবাক করার মতো বিষয়ই। এসব নিয়ে কম-বেশি সমালোচনা হয়, সেটাও বোধ হয় জানেন সাকিব নিসার। এ কারণেই তিনি সরাসরিই বলেছেন, নির্বাহী বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করার ইচ্ছা তাঁর ছিল না। কিন্তু নাজুক পরিস্থিতির কারণে তিনি হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হন। বিভিন্ন সরকারি সেবা দিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে কোনো সময় আমাকে ডাকুন, আমি সীমারেখা পেরিয়ে যাব।’

চলতি বছরের জুলাই মাসে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। তার আগে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির বিভিন্ন তৎপরতা দেশটির জাতীয় রাজনীতিকে বিকৃত করছে। বিশেষ করে নওয়াজের দল কিংবা তাঁর দলের নেতৃত্বাধীন সরকারের ব্যর্থতাই তুলে ধরছে। বেশির ভাগ সমস্যা যেন নওয়াজের দলে ঘাঁটি বলে পরিচিত পাঞ্জাব প্রদেশে। সেগুলোতেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশি। সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে সেগুলোতে উন্নতি না ঘটালে লাহোরের নতুন মেট্রো ব্যবস্থার কাজ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন প্রধান বিচারপতি। এ ছাড়া আরও কিছু বিষয়ে বর্তমান সরকারের নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। তাঁর এমন ভূমিকায় দেশটির আইনজীবী জুনায়েদ জাহাঙ্গীর মন্তব্য করেন, ‘প্রধান বিচারপতি দেশের প্রধান বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করছেন।’

প্রধান বিচারপতি মিয়া সাকিব নিসার

পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রধান বিচারপতির এসব কার্যক্রমকে প্রায় সব সময় প্রশংসা করে আসছে। প্রধান বিচারপতি তথা সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা শুধু সরকারের নয় বিরোধী দলের জন্যও উদ্বেগের—এমনটাই মত কলামলেখক ও আইনজীবী বাবর সাত্তারের। তিনি বলেছেন, আদালতের এমন ভূমিকা গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ সংকুচিত করছে।

আদালতের বা প্রধান বিচারপতির এমন ভূমিকার কথা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কানে যেন ‘সুমধুর সুর’ হয়ে বাজছে। সংবিধানের যে অনুচ্ছেদ বলে নওয়াজকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই ৬২ নম্বর অনুচ্ছেদ ১৯৭৩ সালে সংবিধানে যুক্ত করা হয় বেসামরিক রাজনীতিকদের বশে আনার জন্য। নওয়াজের দলের নেতারা নানা সময় পরোক্ষভাবে এ কথা বলে আসছেন যে, বিচার বিভাগ সেনাবাহিনীর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাষ্ট্রের এই দুটি প্রতিষ্ঠান যে কোনো মূল্যেই পরস্পরকে সুস্পষ্টভাবেই সমর্থন দিচ্ছে। পূর্বসূরি সাবেক প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মোহাম্মদ চৌধুরীর মতো বর্তমান প্রধান বিচারপতি সাকিব নিসার দেশটির গুম বা মানুষ হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার প্রসঙ্গ এলেই এড়িয়ে যান। কারণ এ বিষয়ে কথা বলাটা সামরিক বাহিনীর অপছন্দ।

সেনাপ্রধান কামার জাবেদ বাজওয়াপাকিস্তানের সেনাপ্রধান কামার জাবেদ বাজওয়া অবশ্য কোনো রাখঢাক না করেই চলতি মাসে ঘোষণা করেন, পার্লামেন্টের সঙ্গে বিচার বিভাগের কোনো বিরোধ হলে তারা বিচার বিভাগের পক্ষেই অবস্থান নেবেন।

পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আসাদ রহমান খান অবশ্য বলেছেন, রাজনীতিবিদেরাই আদালতের হাতে অস্ত্র তুলে দেন। নওয়াজ শরিফ তাঁর শেষ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চার বছর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তিনি এই চার বছরে মাত্র ছয়বার পার্লামেন্টে হাজির হয়েছিলেন। আর পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডে সমর্থন দেওয়ার রাজনীতিকেরও অভাব নেই।

যাই হোক, পাকিস্তানের গণতন্ত্র কোন দিকে যাবে তা সময়েই বলে দেবে। তবে জুলাইয়ে জাতীয় নির্বাচন হলে হয়তো পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) বা তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সরকার গঠন করবে। তবে যে-ই সরকার গঠন করুক, তার গলায় যে সামরিক বাহিনীর বুট ও মাথায় হাতুড়ি থাকবে, সেটা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক

manik.mahfuz@gmail.com