জন্ম হয়েছিলো গ্রিসের মধ্যবিত্ত এক পরিবারে। বাবার ছিলো ব্যবসা। আনন্দে কেটে যেত বালিকার দিন। এতই উচ্ছ্বল আর দুরন্ত ছিলো যে তাকে সবাই দুষ্টু হরিণি বলে ডাকতো। ১৩ বছরের সেই বালিকার নাম আনাস্থাসিয়া। তার কোলে একটি মেষশাবকসহ আঁকা একটি ছবি অটোমান সাম্রাজ্যের তোপকাপি প্রাসাদে পাঠানো হয়। সেটি রাজ্যাভিষিক্ত সুলতান আহমেদের নজরে পড়ে। সুলতান ওই চিত্রকর্মে প্রভাবিত হয়ে পড়ায় তার দাদী সাফিয়া সুলতান সেই আনাস্থাসিয়াকে তোপকাপি প্রাসাদে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন।
শুরু হয় এক মন খারাপের গল্প। এই মন খারাপি গল্প থেকেই জন্ম নেন দুনিয়া কাঁপানো নারী ‘কোসেম সুলতানা’। নিতান্তই বালিকা আনাস্থাসিয়াকে অপহরণ করে নিয়ে আসা হয় তোপকাপি প্রাসাদে। তার স্থান হয় হেরেমে বাদশাহের বাদীদের সঙ্গে। তবে বয়স কম হওয়ায় এবং উষ্ণ মেজাজী, শিশুসুলভ আচরণে সে বিরক্ত হয় রাজপ্রাসাদের নিয়ম কানুনে। তার সারলে প্রাসাদের সবাই মজা নিলেও তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন বাদশাহ সুলতান আহমেদ। ভালোবেসে তিনি আনাস্থাসিয়ার নাম দেন ‘নাসিয়া’।
ভালোবাসা কী, এর কী অনুভূতি জানে না নাসিয়া। তাই অন্য দাসীদের মতো বাদশাহকে কাছে পাবার আকুতি নেই তার। বাদশাহকে বশ করার কোনো ইচ্ছেও নেই তার। বাদশাহ সুলতান আহমেদ ছিলেন নমনীয় মনের। মন থেকেই ভালো বাসতেন নাসিয়াকে। তাই বারবার কাছে পেয়েও জোর করে তাকে ভোগ করেননি; সবরকম ক্ষমতা ও শক্তি থাকার পরও। অপেক্ষা করেছেন নাসিয়া একদিন তার ভালোবাসায় সাড়া দেবেন বলে।
সেই অপেক্ষার প্রহর কাটে। সাবালিকা নাসিয়া একদিন ঠিকই অনুধাবন করতে শেখে তার যে হৃদয় বাবা-মাকে দেখবে বলে ব্যাকুল হয়ে থাকে প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যেতে সেই হৃদয়ে শক্ত আসন গড়ে বসে আছেন সুলতান আহমেদ। সে উপলব্দি করে, বাদশাহ তার বিরহে কাঁদবে, কষ্ট পাবে। তাই পালানোর সব সুযোগ থাকার পরও নাসিয়া ফিরে আসে। বাদশাহ অপেক্ষার পালা কাটিয়ে নাসিয়ার ভালোবাসা পেয়ে মোহিত হন। তিনি ঘোষণা করেন, নাসিয়াকে পাওয়া তার জীবনের সবচেয়ে বড় জয়। নাসিয়াকে এও বলেন, একদিকে তার পুরো পৃথিবী আর একদিকে নাসিয়া। বাদশাহর এই ভালোবাসাই নাসিয়াকে ধরে রাখে প্রাসাদে। দাসী থেকে করে তুলে অনন্য এক নারী। যার নাম আজও উচ্চারিত হয় বিশ্ব রাজনীতিতে অনেক সম্মানে।
নাসিয়ার প্রতি বাদশাহের গুরুত্ব লুকানো থাকে না। সবাই বুঝতে পারে, এই মেয়ে সাধারণ বাদী নয়। সেই বাদশাহর মনের মানুষ। নাসিয়াও সেই গুরুত্ব উপলব্দি করে নিজেকে মেলে ধরতে থাকে। যারা তাকে নানাভাবে অপমান করতো, অপদস্ত করতো তাদেরকে শায়েস্তা করতে থাতে।
নাসিয়া পড়ে যায় রাজপ্রাসাদের নারীদের কূট রাজনীতির ফাঁদে। যেখানে বাদশহা সুলতান আহমেদের দাদী সাফিয়া সুলতানা, মা হানদান সুলতানা ও সৎ মা হালিমা সুলতানা ত্রিমুখী লড়াইয়ে যুক্ত। নাসিয়াকে সবাই ব্যবহার করতে চায় বাদশাহের সবেচেয়ে কাছের বলে। তবে নাসিয়া এইসব এড়িয়ে চলে। তার সারল্য তাকে সবকিছু থেকে মুক্ত রাখে, বাদশাহর কাছে করে তুলে অসাধারণ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না নাসিয়া। তাকে নোংরা রাজনীতিতে পা রাখতেই হয়। নানামুখী দ্বন্দ্ব সংঘাতে নাসিয়া হয়ে উঠে প্রাসাদের সবচেয়ে প্রবীন ও ক্ষমতাধর নারী সাফিয়া সুলতানার প্রতিদ্বন্দ্বী। ততদিনে নাসিয়ার নামের শেষে যোগ হয়েছে ‘কোসেম’। যার অর্থ পথ প্রদর্শনকারী।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বাদশাহ সুলতান আহমেদের ফুফু ফারিয়া সুলতানা দ্বারা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হন বাদশাহ ও তার সৎ ভাই মুস্তাফা। এতে গুটি বসন্ত হয় বাদশাহর। তাকে মৃত্যুপথযাত্রী দেখেও তাকে সুস্থ না করে তার বদলে মুস্তাফাকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজের ক্ষমতা বাড়িয়ে নিতে চায় সাফিয়া সুলতানা। এ নিয়ে ঘটে অনেক নাটকীয়তা। সাফিয়ার ইশারায় সিপাহি ও প্রজাদের ক্ষেপিয়ে তুলেন তার পোষ্য মন্ত্রীরা। সবাই যখন মৃতপ্রায় বাদশাহকে রেখে প্রাসাদ ছেড়ে পালাতে উদ্যত হয় তখন মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এগিয়ে আসে নাসিয়া। ক্ষুব্ধ সিপাহিদের সে শান্ত করে বুদ্ধিমত্তায়। তার এই সাহস, বুদ্ধি দেখে অভিভূত হয়ে পড়ে প্রজারা। এরপর থেকেই তার নাম দেয়া হয় কোসেম। পরবর্তীতে সুলতান আহমেদের সঙ্গিনী হিসেবে তিনি হয়ে উঠেন কোসেম সুলতানা। সুলতানকে বিয়ের পর তিনি হাসেকি সুলতান হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন।
তিনি তার স্বামীর মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন করে উসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন এবং সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। কোসেম রাজপ্রাসাদে আসার পর থেকে মৃত্যু অবধি ছয়জন সুলতানের শাসনকাল দেখেছেন। তার মধ্যে তার নিজের দুই পুত্র চতুর্থ মুরাদ, ইব্রাহিম ও নাতি চতুর্থ মুহাম্মাদও ছিলেন। কোসেম ইস্তাম্বুলসহ তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে নানা রকম স্থাপনা গড়ে তুলেছিলেন। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন গরীব প্রজাদের। বিশেষ করে গরীব মেয়েদের শিক্ষা ও বিয়ে দেয়ার কোসেমের অবদান অনেক।
আনুমানিক ১৫৮৯ সালে জন্ম নেয়া কোসেমের মৃত্যু হয় ১৬৫১ সালে। তিনি পাঁচ শাহজাদা ও চার শাহজাদীর জন্ম দিয়েছিলেন। মৃত্যুর পর তাকে স্বামী সুলতান আহমদ খানের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।
অটোমান সাম্রাজ্যে এই নারীর কীর্তি নিয়ে তুরস্কে নির্মিত হয়েছে সিরিয়াল ‘মুহতেশেম ইউজিয়েল : কোসেম’। এখানে কোসেমরে জীবনকে দেখানো হয়েছে তিনটি পর্যায়ে। বালিকা আনাস্থাসিয়া, যুবতী কোসেম এবং পরিণত বয়সের কোসেম সুলতানা। তিনটি পর্যায়ে অভিনয় করেছেন আনাস্থাসিয়া চরিত্রে আনাস্থাসিয়া টিসিলিম্পু, কোসেম চরিত্রে তুরস্কের জনপ্রিয় অভিনেত্রী বেরেন সাত এবং কোসেম সুলতানা চরিত্রে অভিনয় করেছেন নূরগুল।
এই সিরিয়ালটি বাংলায় ডাবিং করে প্রচার করা হচ্ছে বেসরকারি টেলিভিশন দীপ্ত টিভিতে।