মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বরিশালের লাখুটিয়া জমিদার বাড়ি আজ অবহেলিত।

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

সোহেল আহমেদ:

★ সংস্কারে জেলা প্রশাসনের সুদৃষ্টি কাম্য।
★ সেনাবাহিনী প্রশিক্ষন দেয় মুক্তিকামী যোদ্ধাদের
বললেন মামুন মাস্টার।

বাড়িতে থাকার নেই কেউ। নেই পাহাড়া দেবার মত একজন মানুষও। অথচ সম্পূর্ন ইটের তৈরি বিশাল আকৃতির এ বাড়িটিই ছিল মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধ কালে প্রথমে সেনাবাহিনী ৯ নং সেক্টরের বরিশালের বীর মুক্তিযোদ্ধা জল কাদের মোল্লা,বাবুগঞ্জের আবদুল ওহাব খান,আব্দুল মজিদ খানদের প্রথমে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। তারা স্থানীয় তরুন যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। যে জন্য শত বছরের জমিদার বাড়িটি আজও ইতিহাসের রাজ স্বাক্ষী হয়ে আছে। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড হলেও কালের গর্ভে বিলীন হতে চলেছে নিস্তব্ধ বাড়িটি। সংস্কারের অভাবে বিলীন হচ্ছে জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য, ম্লান হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ কালের ইতিহাস। মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও এলাকা বাসি মনেকরে , বরিশালের জেলা প্রশাসন এগিয়ে এলেই বাড়িটির সংস্কার কাজ সম্ভব। দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা যায় এসব তথ্য।

Image may contain: outdoor

বরিশাল নগরীর বিমান বন্দর থানার ২ নং কাশিপুর ইউনিয়নের লাখুটিয়া গ্রামে ( বাবুরবাড়ি) অবস্থিত এ বাড়িটির আয়তন ছিল প্রায় ৫০ একর। প্রাচীন জমিদারী প্রথা ব্যবস্থায় শেষ পর্যন্ত চারজন রাজা এখানে বসবাস করে তাদের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। রাজা রায়েত চন্দ্র রায়,সুরেন বাবু,ঘুগু বাবু ও রাখাল বাবু সবাই পরোলক গমন করলেও বেঁচে আছেন বংশধরগন। এর মধ্যে জমিদার কন্যা মন্দিরা দেবী বরিশাল মুখার্জি বাড়িতেই বসবাস করছেন। বাকি সবাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন।

বাড়ির প্রবেশ মুখেই রয়েছে বিশাল আকৃতির পদ্ম পুকুর যা পদ্ম দিঘী নামেই বরিশাল ব্যাপী পরিচিত। রয়েছে একটি উচ্চতা সম্পন্ন প্রাচীন মন্দিরসহ ছোট বড় ছয়টি পুরনো উঁচু মঠ । আছে সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় দুটি দিঘী। বাড়ির দক্ষিন পশ্চিম প্রান্তে বিশাল একটি সারসী দিঘী। এই দিঘীর নামেই রাখা হয়েছে স্থানীয় সারসী গ্রাম।

জমিদার বাড়ির নিচতলায় একটি সুরঙ্গ পথ রয়েছে। জমিদাররা কয়েকটা সুরঙ্গ খুড়ে বানর পালতেন। সাথে অন্যান্য বন্যপ্রাণীরও বিচরণ ছিল এখানে।
একসময়ের এসব জমিদাররা এলাকার হতদরিদ্র মানুষের সহয়তা এগিয়ে এসেছেন। স্থানীয় নাম করা পি, আর, সি ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষিত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন। সৃস্টি করেছেন দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান। জমিদাররা ছিলেন পরোপকারী। যাকে যে ভাবে পেড়েছেন সাহায্য করেছেন।

No automatic alt text available.

ইতিহাস শুধু জমিদারি প্রথাব্যবস্থারই নয়। বাড়িটি ঘিরে আছে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক জলন্ত প্রমান। মুক্তিযুদ্ধ কাল সময়ে ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল এই বাড়ি। প্রথমে তৎকালীন সেনাবাহিনী শত্রুদের মোকাবেলা করতে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব খান,জল কাদের মোল্লা,আব্দুল মজিদ খানদের প্রশিক্ষণ দেয়। এর মধ্যে মেজর জলিল ছিলেন প্রধান। তার অধিনস্ত মেজর মন্জুরুল ইসলাম এই প্রশিক্ষণ পরিচারণা করেন।

সেনাবাহিনী কতৃক প্রথমে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে আব্দুল ওহাব খান,জলকাদের মোল্লা ও আব্দুল মজিদ খান বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে স্থানীয় মুক্তি কামী বীর সেনাদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। একটা সময় জমিদার বাড়িটি হয়ে ওঠে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা দেয়া বীর সেনাদের প্রানকেন্দ্র। এখান থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রব ( মাস্টার) , ডা: হারুন অর রশিদ,আব্দুল বারেক পঞ্চায়েত ,সৈয়দ আবু তাহের,আবুল কাশেম (মানিক), রহমত আলী,সেকান্দার মাস্টারসহ শত শত সৈনিক। মুক্তিকামী মানুষের খোঁজ খবর নিতে তখন বর্তমান সরকারের শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুও এই বাড়িতে এসেছিলেন।

Image may contain: 1 person, tree, plant, sky and outdoor

স্মৃতি বিজরিত ঘটনাবহুল ঐতিহাসিক বাড়ির বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। চারপাশের দরজা,জানালা,লোহার ভীম বেশ পুরনো হয়ে গেছে। ভেঙ্গে গেছে সিঁড়ি। যে বাড়িতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নানা ইতিহাস, অবহেলা, অযত্নে বিলীনের পথে সেই বাড়িটিই। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সন্তান আবু আহমেদ আল মামুন মাস্টার বলেন,আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান রয়েছি তারা সবাই চাচ্ছি বাড়িটি সংস্কার করা হোক। বরিশাল অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কেবল বই পড়েই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারছে। বাড়িটি সংস্কার করে এর সঠিক ইতিহাস তরুন প্রজন্মের নিকট তুলে ধরা উচিৎ। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সকলকেই নিজ অবস্থান থেকে দ্বায়িত্ব নিতে হবে বলে তিনি মনেকরেন।

জানতে চাইলে, রাজা রায়েত চন্দ্রের পুত্র দেবেন বাবুর কন্যা মন্দিরা দেবী ( বুখাই দেবী নামে পরিচিত) প্রতিবেদককে জানান,মাটির টানে বাড়িটির অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই মানুষের মুখার্জি বাড়িতে রয়েছি। বাবদাদার ভিটেবাড়ির প্রতি মায়া কার না রয়েছে? এমন প্রশ্ন করে তিনি বলেন, লাখুটিয়ার হাজারও মানুষের ভালোবাসা আছে আমাদের প্রতি। তারাও চান অন্তত মূল বাড়িটার সংস্কার করা হোক। মন্দিরা দেবী বলেন,বিগত দিনে অনেকবার সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে তৎপরতা শুরু করেছিলাম।

Image may contain: outdoor, nature and water

হঠাৎ সারা দেশে যে সিরিজ বোমা হামলা হয়,ওই হামলায় ঝালকাঠী আদালতের বিচারক মন্দিরা দেবীর মেয়ে জামাই নিহত হন। শোকাহত মন্দিরা দেবীর এ নিয়ে আর আগানো সম্ভব হয়নি। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,বরিশাল জেলা প্রশাসক শ্রদ্ধেয় হাবিবুর রহমান মহোদয় আমাদের মুখার্জি বাড়িতে এসেছিলেন। আমরা লাখুটিয়া জমিদার বাড়িটির জন্য এলাকার বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ নিয়ে স্যারের কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি।

উল্লেখ্য, সরকার ১৯ শতকের দিকে জমিদারবাড়িটি নিলামে নিয়ে নেয়। তারপরই গড়ে ওঠে আজকের লাখুটিয়া কৃষি খামার। প্রায় একযুগ ধরে এই কৃষি খামারের প্রধান অফিস হিসেবে বাড়িটি ব্যবহৃত হয়েছিলো।
প্রাচীন ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটি দেখার জন্য প্রতিদিন দূর -দূরান্ত থেকে হাজারো দর্শনার্থী বেড়াতে আসছে। বিকেল হলেই যেন বাড়ির চারদিক নানা বয়সের মানুষের বিনোদন কেন্দ্রে পরিনত হয়।

লেখক: সোহেল আহমেদ,
সাংবাদিক।

Image may contain: outdoor

Image may contain: sky and outdoor