যেভাবে বাংলাদেশকে দমনের চেষ্টা করেছিলেন হিলারি

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের অন্যতম দাতা ও ক্লিনটন পরিবারের এক বন্ধুকে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত থেকে বাঁচাতে গিয়ে বাংলাদেশকে দমনের চেষ্টা করেছিলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। পারিবারিক বন্ধুর দুর্নীতির তদন্ত থামাতে শুধু প্রাণপণ চেষ্টাই করেননি তিনি; বাংলাদেশের ওপর অনৈতিক অনধিকার চর্চাও করেছিলেন সাবেক এই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

শান্তিতে বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে গ্রামীণ ব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ বন্ধ করতে বাংলাদেশ সরকারের ওপর হুমকি-ধামকি ও চাপ প্রয়োগ করেছিলেন হিলারি। মার্কিন দৈনিক ডেইলি কলারের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

 ‘তারা দফায় দফায় আমাকে বলেন, ইউনূসের অনেক প্রভাবশালী বন্ধু আছে। আর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্লিনটনের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টিও গোপন কোনও ব্যাপার নয়’ 

মার্কিন এই দৈনিক দাবি করে বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের অনুরোধে বাংলাদেশের দুটি সরকার বেশ কিছু নথি দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দরিদ্রতম দেশটির বিরুদ্ধে ‘হার্ড-বল’ কৌশলের ব্যবহার করে ক্লিনটন তার কোটিপতি বন্ধু এবং ফাউন্ডেশনের দাতাকে সাহায্য করার জন্য বিরক্তিকর ছায়া ফেলেছিল।

নথিতে দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ ব্যাংক নামে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের আর্থিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগের সম্মুখীন ইউনূসকে বাঁচাতে হিলারি ক্লিনটন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর, দূতাবাস এবং বিশ্বব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি পরিকল্পনা আঁকেন। পরে ইউনূসকে ওই ব্যাংক থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

ইউনূসের মোট সম্পদের পরিমাণ ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক দাতব্য প্রতিষ্ঠান ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে ৩ লাখ ডলারের বেশি দান করেছিলেন তিনি।

২০১০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ইউনূস একাধিক আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের মুখোমুখি হন। এর মধ্যে ডেনমার্কের ডক্যুমেন্টারিতে উঠে আসে তিনি কীভাবে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নিয়েছেন।

ইউনূসের বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগ বাংলাদেশে ব্যাপক তোলপাড় ফেলে; যেখানে মাথাপিছু বার্ষিক আয় প্রায় এক হাজার ডলার।

ইউনূসের হয়ে ক্লিনটন বারবার এবং সরাসরি বাংলাদেশকে হুমকি-ধামকি দেন। এমনকি তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক যে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন দিয়েছে; তা প্রত্যাহার করে নেবে।

বিশ্বব্যাংকের সর্ববৃহৎ দাতা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০১১ সালে দেশটি বিশ্বব্যাংককে ১৫০ কোটি (দেড় বিলিয়ন) ডলার দান করে। হিলারি ক্লিনটন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এই ব্যাংকের ওপর প্রচণ্ড রকমের প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন।

মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রধান শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের ভীত নাড়িয়ে দিতে ও অপমান করতে পদ্মা সেতু ইস্যুতে ক্লিনটনের পদক্ষেপ আগে থেকেই সাজানো হয়েছিল। মার্কিন আরেক প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে শেখ হাসিনা সরকারের প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলোর একটি হচ্ছে পদ্মা নদী প্রকল্প।

তিনি রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের একটি অনুন্নত অঞ্চলের সংযোগ স্থাপনে পদ্মা নদীর ওপর একটি রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণের আশা করেছিলেন; যা নতুন ব্যবসায়িক বিনিয়োগ ও হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।

হিলারি ক্লিনটনের ঔদ্ধত্যমূলক চাপ প্রয়োগ কৌশল ও ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের দাতার পক্ষে বিশ্বব্যাংককে ব্যবহার মার্কিন সিনেটের কমিটিতে চলমান তদন্ত আরও বিস্তৃত হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট দেশের বিরুদ্ধে হিলারি ক্লিনটনের চাপ প্রয়োগ কৌশলের তদন্ত করছে সিনেটের বিচার বিভাগীয় কমিটি।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের সময় সজীব ওয়াজেদ জয়ের মাধ্যমে ওই সময় মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে আর্থিক হিসাব তদন্তে (আইআরএস) শেখ হাসিনাকে হুমকি দেয়া হয়েছিল কি না তা জানতে চলতি বছরের ১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর ও সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান চাক গ্রাসলি বর্তমান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের বক্তব্য চান।

আইওয়া অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান দলীয় এই রাজনীতিক ডেইলি কলারকে বলেন, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের দাতাকে বাঁচাতে বিশেষ বিবেচনার জন্য আর্থিক হিসাব বিভাগের তদন্ত ব্যবহার করে অথবা অন্য কোনো চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল কি না তা জানতে আমি পররাষ্ট্র দফতরের কাছে প্রতিনিয়ত জবাব চাইব।

হিলারি ক্লিনটন খোলস ঝেড়ে বেরিয়ে আসেন ২০১১ সালের শুরুর দিকে; যখন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মণির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

সেই সময় দীপু মনি বলেন, মরিয়ার্টি স্পষ্ট করে বলেন, আমরা যদি ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ না করি, তাহলে বেশ কিছু ফলাফলের মুখোমুখি হতে হবে। উদাহরণ হিসেবে মরিয়ার্টি বলেন, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেবে।

এসময় দীপু মনি মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির কােছে জানতে চান, একটা নির্বাচিত সরকার হিসেবে, জনগণের সরকার হিসেবে আমরা কেন ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে উঠা অনেক গুরুতর অভিযোগের তদন্ত করবো না। মরিয়ার্টি এসময় গ্রামীণ ব্যাংককে ‘স্বতন্ত্র’ এবং ‘বেসরকারি সংস্থা’ বলে হিলারি ক্লিনটনের দাবির পুনরাবৃত্তি করেন।

তিনি বলেন, দরিদ্র মানুষকে; বিশেষ করে নারীদেরকে সহায়তার জন্য পরীক্ষামূলক ‘ক্ষুদ্র-ঋণ’ কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা। গ্রামীণ ব্যাংকের ২৫ ডলারের ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতারা ছোট্ট ব্যবসা শুরু করার অনুমতি পেতেন। দীপু মনি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এসব মন্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক ছিল রাষ্ট্রের তালিকাভূক্ত এবং সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত একটি ব্যাংক। সরকারি নথিতে গ্রামীণ ব্যাংককে রাষ্ট্রীয় হিসেবে দেখা যায়।

ইউনূস ইস্যুতে হিলারি ক্লিনটন তার আক্রমণ আরো শানাতে থাকেন। নথিতে দেখা যায়, ২০১১ সালের মার্চে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেইক ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে ইউনূসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের তদন্ত বন্ধ করতে খুবই জেদ দেখান। বাংলাদেশ সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হককে দ্রুত সরিয়ে দেয়ার দাবি জানান মরিয়ার্টি।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই বৈঠকে ব্লেইক ও মরিয়ার্টি ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেমস ওফেনসন উপস্থিত ছিলেন। জেমস ওফেনসনকে বিশ্বব্যাংকের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটনের স্বামী ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। বৈঠকে ইউনূসের বিষয়ে আলোচনার সময় জেমস ওফেনসন সামান্য বিব্রতবোধ করেন।

সেই সময়ের ওই বৈঠকের বিষয়ে জানতে ডেইলি কলার বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই প্রধানের অফিসের সঙ্গে যোগাযাগ করেছে। এ ব্যাপারে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না বলে তার গণমাধ্যম প্রতিনিধি জানিয়ে দিয়েছেন। ইউনূসের জন্য তদবির ও সরকারের ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করতে দেশের এলিট শ্রেণির তালিকা তৈরি করেন রবার্ট ও ব্লেইক।

রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির বাসভবনে এক অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেইক দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দেন যে, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধানের পদে ইউনূসের থাকা উচিত। ব্লেইক বলেন, অন্যথায় ওয়াশিংটন এমন পদক্ষেপ নেবে; যা দুই দেশের দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ব্লেইকের সঙ্গে কথা বলা অব্যাহত রাখেন। নথিতে তিনি বলেন, এটা মনে হয়েছে যে, আমরা যা বলছি তার কোনো কিছুই শুনতে তারা প্রস্তুত নন। দীপু মনি বলেন, এক ফোনালাপে তাকে খুব, খুব জেদি হয়েছিল। এটা পরিষ্কার করা হয়েছিল যে, যদি আমরা বাধ্য না হই তাহলে পরিণতি ভোগ করতে হবে।

দীপু মনির সঙ্গে প্রত্যেকবার সাক্ষাতের সময় ইউনূসের বিষয়টি তুলতেন হিলারি ক্লিনটন। এমনকি ২০১২ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও হিলারি একই দাবি জানান। দীপু মনি বলেন, আমরা বারবার ব্যাখ্যা করেছি যে, গ্রামীণ ব্যাংক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা ছিল এবং এটি অবশ্যই তার নিজস্ব সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হবে। আমাদের সংবিধানসহ অন্যান্য আইন-কানুন মানবে; কিন্তু এটি দৃশ্যত লঙ্ঘন করেছিল। তিনি বলেন, সবকিছু যেন বধির কোনো ব্যক্তির কানে পড়ছিল।

মনি বলেন, এটা স্পষ্ট ছিল যে, অবৈধ কাজ করলেও ইউনূসকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রাখতে চেয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। সজীব ওয়াজেদ জয় সে সময় বলেছিলেন, ‘১৭ বছর ধরে বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকালে কখনও তার কোনও সমস্যা হয়নি। তবে ড. ইউনূসের ব্যাপারে তদন্তের ঘটনায় মার্কিন কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগে তদন্ত শুরুর হুমকি দেন।’

জয় ডেইলি কলারকে আরও বলেন, ‘তারা দফায় দফায় আমাকে বলেন, ইউনূসের অনেক প্রভাবশালী বন্ধু আছে। আর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্লিনটনের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টিও গোপন কোনও ব্যাপার নয়।’

এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন আটকাতে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে ইউনূসের যোগসাজশের বিষয়টি উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে, গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে ইউনূসকে না সরাতে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে চাপ আসার কথাও স্বীকার করেন।

২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির যড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি বাতিল করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার নিজ উদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেই। ইতোমধ্যে সেতুটির প্রায় ৪০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে রিপাবলিকান পার্টি ঘেঁষা ডেইলি কলারেরই এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্টপ্রার্থী হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় নিজ পদের প্রভাব খাটিয়ে ইউনূসকে এক কোটি ৩০ লাখ ডলারের তহবিল জুগিয়েছিলেন। অন্যদিকে, ইউনূস এক লাখ থেকে তিন লাখ ডলার ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে দান করেছিলেন। ওই সময় ক্লিনটন ফাউন্ডেশন থেকে বিষয়টি অস্বীকার করা হয়।

২০১৫ সালে হিলারির ফাঁস হওয়া ই-মেইলেও ইউনূসের জন্য তদ্বিরের বিষয়টি প্রকাশ পায়। ইউনূসকে সরানোর কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চাপ আসার কথা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময়ে বলেছেন।