ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক বাংলাদেশের একজন মুক্তমনা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। একাধারে কবি, প্রবন্ধকার ও গবেষক। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়ে গবেষণায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাকে রবীন্দ্রত্ত্বাচার্য উপাধিতে ভূষিত করেছে। ব্যক্তি জীবনে আহমদ রফিক একজন চিকিৎসক। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে তার সঙ্গে কথা বলেছেন সমকাল অনলাইনের সহ-সম্পাদক মিছিল খন্দকার।
ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয়া অংশগ্রহণকারী হিসেবে তার কাছে উত্তাল সেই সময়ের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। প্রথমেই তিনি ৫২ একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, স্কুলজীবন থেকে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি করি। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তখন। ৫০ সাল থেকে ছাত্রজনতার প্রতিবাদ মিছিল, সভা-সমাবেশ সবকিছুতে যোগদান করেছি। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি মিছিলে শ্লোগান ধরতাম। ৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি বার লাইব্রেরিতে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায়ও উপস্থিত ছিলাম। আর একুশে ফেব্রুয়ারি আমতলায় জড়ো হয়েছিলাম ছাত্রনেতার সঙ্গে।
সেই সময়ে তো এক ধরণের আদর্শ ও স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, এর হাত ধরে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, তো আপনার বা আপনাদের স্বপ্ন কতোটা বাস্তবায়িত হয়েছে- জানতে চাইলে এই ভাষা সৈনিক বলেন, ৫২ সালে আমাদের শ্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বংলা চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’ ও ‘সর্বস্তরে বাংলা চাই’। এই তিন স্লোগান ছিল আমাদের মূলমন্ত্র। এরপর তো ৭২ এর চমৎকার সেক্যুলার সংবিধান হলো। এতে বলা হলো, উচ্চ আদালতসহ রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রের ভাষা হবে বাংলা। কিন্তু এরপর আমরা কী দেখেছি! উচ্চ আদালতে বাংলা প্রতিষ্ঠা হলো না। রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে যত্রতত্র ইংরেজির ব্যবহার হতে থাকলো। একে একে দেশ ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজে ভর্তি হয়ে গেলো।
আসলে যদি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাকাই তবে বলব, শুধু রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি ছাড়া চেতনা সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে সাহিত্য-সংস্কৃতির বৈপ্লবিক ও গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। অর্থাৎ সাহিত্যের চরিত্র আমূল পাল্টে প্রগতিশীলতার দিকে ধাবিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটেছে কবিতায়। ভাষা আন্দোলনের পরপরই আমরা তিনটা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন পেয়েছি। এর একটি হয়েছে ৫২ সালের আগস্টে কুমিল্লা শহরে, পরেরটি ৫৪ সালে কার্জন হলে ও ৫৭ সালে কাগমারি সম্মেলন। প্রত্যেকটি সম্মেলনে আমরা আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ লক্ষ্য করেছি। আর কাগমারি সম্মেলনে যুক্ত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা।
আদালতসহ সবক্ষেত্রে বা সর্বস্তরে বাংলা চালুর বিষয়ে জোর দাবি জানান এই ভাষা সংগ্রামী। এক্ষেত্রে করণীয় বিষয়ে তার পরামর্শ জানতে চাইলে বলেন, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত ছিল। জাতীয় জীবনের সবক্ষেত্রে ভালো বাংলা, শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার হোক এই আমার চাওয়া। এই যে সাইনবোর্ড, ব্যানার, বিলবোর্ড, দাপ্তরিক কাজগপত্রে ভুল বাংলা, বাংলার সঙ্গে ইংরেজির মিশ্রণ ঘটানো দোআঁশলা বাংলা- এসব একুশের চেতনার পরিপন্থী। এর দায়-দায়িত্ব শিক্ষা-সংস্কৃতি বিভাগ ও সর্বপরি সরকারের। সরকারকেই উদ্যোগী হয়ে সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে হবে ও দোঁআশলা বাংলার ব্যবহার পরিহারে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সমাজের সচেতন অংশ যারা, তাদেরও দায় আছে। তাদের এই দোআঁশলা বাংলা ও ইংরেজি ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হবে।
২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতির যে অর্জন- এর মধ্য দিয়ে বাংলাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া বা এ জাতীয় কোনো সুফলতা পাওয়া গেছে কিনা- এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়ে এই গুণী ব্যক্তিত্ব বলেন, এটার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভাষার প্রচার-প্রচারণা যতোটা হওয়ার কথা ছিল, হয়নি। যেমন ধরুন, দূতাবাসগুলো বিভিন্ন উপলক্ষে বাংলা ও ওই দেশের ভাষায় ব্রোসিয়ার বের করতে পারে, বাংলা ভাষা নিয়ে বিদেশিদের অংশগ্রহণমূলক সেমিনার করতে পারে, দূতাবাসে প্রবাসীদের জন্য বাংলাভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু সরকার বা সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোকে এসব বিষয় খুব একটা উদ্যোগী হতে দেখা যায় না। তবে এখন ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনো কোনো দেশে হচ্ছে, যেমন ইংল্যান্ডে কিছু কিছু সেমিনার বা এসব হচ্ছে। তবে সরকারি উদ্যোগ সবচেয়ে জরুরি।