প্যারাডাইস পেপারসে এবার মুসা বিন শমসের

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago
মুসা বিন শমস

  • মাল্টায় কোম্পানি খুলেছেন বাংলাদেশি ২০ ব্যবসায়ী।
  • কেউ কোম্পানি খুলেছেন নিজের নামে, কেউ ভিনদেশির নামে।
  • উদ্দেশ্য অর্থ পাচার।
  • পানামা পেপারসে ২৪ জন বাংলাদেশির নাম এসেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের জোট দ্য ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) ‘প্যারাডাইস পেপারস’ কেলেঙ্কারির সাম্প্রতিক তথ্যে এসব নাম এসেছে।

এর আগে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত অর্থ পাচারের আরেক আলোচিত অনুসন্ধান ‘পানামা পেপারসে’ ২৪ জন বাংলাদেশির নাম এসেছিল। এরপর গত বছরের নভেম্বরে বের হয় ‘প্যারাডাইস পেপারস’ নামে নতুন কেলেঙ্কারি। এ কেলেঙ্কারির তথ্য প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যন্ত আটটি অঞ্চলের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে পাওয়া গেল ২০ জনের নাম।

২০ বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর নামের সঙ্গে দেশ-বিদেশের অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম যুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ কেউ নিজের নামে, কেউ ভিনদেশির নামে, কেউ আবার দেশ-বিদেশের একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে মাল্টায় কোম্পানি খুলেছেন। তাঁরা শিপিং, বস্ত্র, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা ও শেয়ারবাজার ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত। আইসিআইজের প্রকাশিত গতকালের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৯৯৩ থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে দক্ষিণ ইউরোপের দ্বীপরাষ্ট্র মাল্টায় কোম্পানিগুলো খোলা হয়। মূলত অর্থ পাচারের জন্যই এভাবে কোম্পানি খোলা হয়ে থাকে।

এর আগে প্যারাডাইস পেপারসের আওতায় উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের শহর অ্যাপলবি কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৯ বাংলাদেশির নাম এসেছিল। আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানে অর্থ পাচারের ঘটনায় একাধিক দফায় বাংলাদেশিদের নাম এলেও এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে এসব ঘটনায় কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। যদিও পাকিস্তানসহ অনেক দেশই তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছে। এমনকি এ কারণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে পদও ছাড়তে হয়েছে।

এদিকে, ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ বিদেশে চলে গেছে, তা চলতি বাজেটের আকারের চেয়ে দেড় গুণ বেশি।

ব্যবসায়ীদের পরিচয়

আইসিআইজের এবারের প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মুসা বিন শমসের ভেনাস ওভারসিজ হোল্ডিংস নামের কোম্পানির পরিচালক এবং ঢাকার বনানীর ১ নম্বর ব্লকের একটি বাড়ি তাঁর ঠিকানা দেখানো হয়েছে। তিনি ২০১০ সালে কোম্পানি নিবন্ধন করেন।

বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে দেশেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ‘অস্বাভাবিক’ সন্দেহ করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিকভাবে রহস্যমানব হিসেবে পরিচিত এই ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাব ২০১১ সালে তলব করেছিল। দুদকের চাহিদা অনুযায়ী এ তলব করা হয়। পরে রহস্যজনক কারণে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

মুসা বিন শমসের হীরকখচিত জুতা পরেন। তাঁর পরনের স্যুট স্বর্ণসুতাখচিত। তিনি নিত্য গোসল করেন নির্জলা গোলাপজলে। দামি ঘড়ি পরেন। দামি গাড়ি ব্যবহার করেন। তাঁকে নিয়ে এই কথাগুলো প্রচলিত। কয়েকবার তাঁর শুনানি নেওয়ার সময় দুদক এসব তথ্য পেয়েছে। তিনি ব্যক্তিগত প্রহরা দল নিয়ে দুদকে আসতেন জাঁকজমকের সঙ্গে। মুসা বিন শমসের আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বেয়াই।

মোহাম্মদ এ আউয়াল নামের এক ব্যবসায়ী মাল্টায় তিনটি কোম্পানির নিবন্ধন নেন। চট্টগ্রামের লালখান বাজারের মাওলানা শওকত আলী সড়কের একটি বাসা তাঁর ঠিকানা। ১৯৯৩ সালে নিবন্ধিত হয় শামস শিপিং লিমিটেড এবং ১৯৯৭ সালে নিবন্ধিত মারজান শিপিং ও কুয়ামার শিপিংয়ের পরিচালক। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের ঠিকানা উল্লেখসহ এ ছাড়া তিন কোম্পানিরই পরিচালক দেখানো হয়েছে মোহাম্মদ এ মালেক নামের আরেক ব্যবসায়ীকে।

আইসিআইজেতে উল্লেখিত ঠিকানা ধরে গতকাল বৃহস্পতিবার আগ্রাবাদে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে দোতলা ভবনে বেঙ্গল শিপিং লাইন লিমিটেডের কার্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, মোহাম্মদ এ আউয়াল বেঙ্গল শিপিং লাইনের চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের পরিচালক। ফিলিপাইনের অনারারি কনসাল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। মোহাম্মদ এ মালেক তাঁরই ছোট ভাই এবং বেঙ্গল শিপিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদ এ আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, এটি সম্পূর্ণ ভুয়া। কারণ, তিনি ও তাঁর ছোট ভাই দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসার মাধ্যমে বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) এনেছেন। বিদেশে টাকা রাখার প্রশ্নই আসে না।

শাহনাজ হুদা রাজ্জাক ও ইমরান রহমানের বাংলাদেশের ঠিকানা ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, সাভার (ডিইপিজেড)। তাঁদের নাম দুবার করে রয়েছে। এ দুজনের ঢাকার ঠিকানা একই। আবার মাল্টায় যেসব কোম্পানি খোলা হয়েছে, সেখানেও একসঙ্গে রয়েছে এ দুজনের নাম।

মাল্টায় সাউদার্ন আইস শিপিং এবং ওশান আইস শিপিং নামে দুটি কোম্পানি খোলেন তাঁরা। অলএন্টি হোল্ডিংস এবং অ্যালান অ্যান্ড পিকার্ড নামক দুটি কোম্পানির সঙ্গেও তাঁরা সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে ইমরান রহমানকে দেখানো হয়েছে ভিয়েতনামপ্রবাসী এবং প্রিয়ম শিপিং লিমিটেড নামক আরেকটি কোম্পানির নিবন্ধন করেন তিনি ১৯৯৯ সালে।

গেক্সিমকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল (এমটি) লিমিটেড নিবন্ধিত হয় ২০০৯ সালে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিনজন ব্যবসায়ী। একজন ফারুক পালওয়ান, যাঁর ঠিকানা ঢাকার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার আজমিরীবাগে। অন্য দুজন চাষাঢ়ার বালুর মাঠের তুহিন ইসলাম ও তাজুল ইসলাম।

ইন্টারপিড গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে ফারহান আকিবুর রহমান ও খন্দকার আসাদুল ইসলামকে। ফারহান আকিবুরের ঠিকানা ঢাকার গুলশানের ৫১ নম্বর সড়কের একটি বাসা, আর খন্দকার আসাদুল ইসলামের ঠিকানা ঢাকার ধানমন্ডির ৪ নম্বর সড়কের একটি বাসা। খন্দকার আসাদুলকে আলাদা করে ২০১৫ সালে নিবন্ধিত ইন্টারপ্রিড ক্যাপিটাল নামের একটি কোম্পানির পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডার দেখানো হয়েছে।

মাল্টায় ২০০৯ সালে পদ্মা টেক্সটাইল নামক কোম্পানির নিবন্ধন করেন আমানুল্লাহ চাগলা। তাঁকে ভারতীয় দেখানো হয়েছে এবং ঢাকার ঠিকানা দেওয়া আছে বারিধারা ডিওএইচএসের ৮ নম্বর লেনের একটি বাড়ি।

২০১৬ সালে নিবন্ধিত ডায়নামিক এনার্জি হোল্ডিংসের পরিচালক দেখানো হয়েছে ফজলে ইলাহী চৌধুরী নামক এক ব্যবসায়ীকে। তাঁর ঢাকার ঠিকানা বারিধারা ডিওএইচএসের ৭ নম্বর সড়কের একটি বাসা।

আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনপ্রবাসী মোহাম্মদ রেজাউল হক ২০১৪ সালে মিলেনিয়াম কলেজ মাল্টা লিমিটেডের নিবন্ধন নেন। একই বছর আয়ারল্যান্ডে থাকা মাহামুদ হোসেন নামের আরেকজন গ্লোবাল এডুকেশন লি. নামক আরেকটি কোম্পানির নিবন্ধন করেন।

রাশিয়াপ্রবাসী আতিকুজ্জামানকে দেখানো হয়েছে নিউ টেকনোলজি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের পরিচালক। ২০১১ সালে নিবন্ধিত আতিকুজ্জামানের মস্কোর ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে, দেশের ঠিকানা উল্লেখ নেই।

বাংলাদেশ ও সুইডেনের নাম উল্লেখ করে এরিক জোহান এনডারস উইলসনের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে ঢাকার উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১৩ নম্বর সড়কের একটি বাড়ি। তিনি ডব্লিউএমজি লিমিটেড নামের কোম্পানির নিবন্ধন নেন ২০০৯ সালে।

এ ছাড়া মোহাম্মদ কামাল ভূঁইয়া ২০০৮ সালে ভূঁইয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং কোম্পানি, ইতালিপ্রবাসী বাংলাদেশি ইউসুফ খালেক ২০১৬ সালের শেষ দিকে কে এ সার্ভিসেস এবং কে এ কনসালটেড নামের দুটি কোম্পানি, ঢাকার বনানী ডিওএইচএসের ঠিকানা উল্লেখ থাকা মাহতাব রহমান ২০০৩ সালে সেলকন শিপিং কোম্পানি এবং ঢাকার ধানমন্ডির ৩ নম্বর সড়কের একটি বাড়ির ঠিকানা থাকা জুলফিকার আহমেদ ১৯৯৯ সালে খালেদা শিপিং নামের একটি কোম্পানির নিবন্ধন করেন।