চা বিরতির মিনিট ১৪ আগের কথা। হঠাৎ চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অন্যরকম প্রাণ চাঞ্চল্য। লঙ্কান স্লো লেফট আর্ম চায়নাম্যান বোলার লক্ষ্মণ সান্দাকানের বলে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে সোজা তুলে দিলেন মুমিনুল হক। বোলারের মাথার ওপর দিয়ে বল চলে গেল লংঅনের ওপারে।
তাতেই ৯৩ থেকে ৯‘তে পৌছে পৌছে যাওয়া। এমন অবস্থায় অনেকেই একটু সময় নেন। ধের্য্য ধরে অপেক্ষায় থাকেন আলগা ডেলিভারির; কিন্তু মুমিনুল তা করলেন না। ঠিক পরের বলেই কভার ও এক্সট্টা কভারের মধ্য দিয়ে সজোরে হাঁকিয়েই প্রান্ত বদলের উদ্দেশ্যে দৌড় শুরু করলেন। বল এক্সট্টা কভার দিয়ে সীমানার ওপারে যেতেই উল্লাসে ফেটে পড়লেন মুমিনুল।
ব্যক্তি জীবনে একদমই শান্তশিষ্ট মুমিনুলের হাঁটা-চলা। অভিব্যক্তির মাঝেও কেমন যেন একটা ধীর-স্থিরভাব। সাফল্যে উদ্বেলিত হন না। আবার ব্যর্থতায়ও থাকেন ভাবলেশহীন। ব্যাট হাতে পঞ্চাশ কিংবা শতরান পুরণের পরও তার অভিব্যক্তি ওরকমই থাকে।
আনন্দ-উল্লাস করেন না বললেই চলে; কিন্তু আজ এক অন্যরকম অভিব্যক্তি-শতরান পুরণের সঙ্গে সঙ্গে এক হাতে ব্যাট ধরে অন্য হাত ঝাঁকি দিয়ে বারবার উল্লাসে মেতে উঠলেন। দর্শক অভিবাদনের জবাব দিলেন ব্যাট তুলে ধরে।
নিজ ড্রেসিং রুমের দিকে ব্যাট ছুড়ে মারার ভঙ্গি করলেন অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে। ব্যাটটা আর কোন দিকে তাক না করেও আরও খানিক্ষণ ঝাঁকুনি দিলেন। টিভির পর্দায় দেখা মিললো সম্পূর্ণ এক ভিন্ন মুমিনুলের। শক্ত চোয়াল আর মুখায়বে অন্যরকম দৃঢ়তা।
বার বার মনে হলো কাকে যেন বলতে চাইলেন, ‘দেখো, আমার সামর্থ্য আছে কি না? আমি পারি কি না? আমি পারি। পেরেছি। দেখেছো? মুমিনুলের ওই ইস্পাত কঠিন অভিব্যক্তি আর অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি উচ্ছাস-উল্লাস আর আনন্দ কী তাহলে প্রতিপক্ষের ড্রেসিং রুমে বসা চন্ডিকা হাথুরুসিংহের উদ্দেশ্যে?
এই প্রশ্ন সবার। মুমিনুল এমন আবেগপ্রবণ হতেই পারেন। তার উল্লাসের ধরণটা ভিন্ন হতেই পারে। রুঢ় হলেও কঠিন সত্য- বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান মুমিনুল সাবেক কোচ হাথুরুসিংহের প্রীতিভাজন ছিলেন না।
এ দেশের টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল উইলোবজ হওয়া সত্ত্বেও হাথুরু কেন যেন মুুমিনুলকে সেভাবে পছন্দ করতেন না। শুধু মুমিনুলের কথা বলা কেন, সাবেক টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম আর নতুন টেস্ট ক্যাপ্টেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও হাথুরুর বিমাতাসূলভ আচরণের শিকার হয়েছেন।
বিশেষ করে হাথুরুসিংহের ইচ্ছে ও কারসাজিতে গত বছর মার্চে দেশের হয়ে শততম টেস্ট খেলা হয়নি মুমিনুল ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের। মুমিনুল অফস্পিনের বিপক্ষে ভাল খেলতে পারেন না। শ্রীলঙ্কার লাইন-আপে বাঁ-হাতি রঙ্গনা হেরাথের সাথে ডানহাতি অফব্রেক বোলার থাকবে, পেস বোলিংয়ের বিপক্ষেও নাকি তার সমস্যা হয়। শর্ট বলতে পারেন না- এমন ধোয়া তুলে মুমিনুলের মত টেস্ট স্পেশালিস্টকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করে ফেলেছিলেন হাথুরু।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শততম টেস্টই শুধু নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজেও সুযোগ পাননি মুমিনুল। সাবেক কোচের রোষানলে পড়েই টেস্ট দল থেকে অবস্থান হারিয়েছিলেন এ বাঁ-হাতি।
মাহমুদউল্লাহও হাথুরুর অবহেলার শিকার। তাকেও কলম্বোয় গত বছর ১০০ নম্বর টেস্টে খুব কায়দা করে বাদ দিয়েছিলেন হাথুরু। মোট কথা, তাদের সাথে হাথুরুর আচরণ ছিল সৎ মায়ের মত।
বোঝাই গেছে তিনি মুমিনুলকে সেভাবে পছন্দ করতেন না। তাদের বাইরে রেখে দল সাজানোর চিন্তা ছিল মাথায়। কখনো কোন ঠুনকো ও ছোট-খাট অজুহাত পেলে একে ওকে দলের বাইরেও ঠেলে দিতে কার্পণ্য করেননি হাথুরু।
তবে এখন পর্যন্ত মাহমুদউল্লাহ-মুমিনুলের কেউ সরাসরি হাথুরুর উদ্দেশ্য করে কিংবা ইঙ্গিতেও কিছু বলেননি। মোটকথা, মুমিনুল, মাহমুদউল্লাহ আর মুশফিকের আচরণ ও কথা শুনে মনে হয়নি তারা চন্ডিকা হাথুরুসিংহের ওপর ক্ষুব্ধ। তার বিপক্ষে সোচ্চার। তাকে দেখিয়ে দিতেও মুখিয়ে আছেন।
বরং সবাই কম বেশি সহিষ্ণু আচরণ করেছেন। যতটা সম্ভব ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্মান নিয়েই কথা বলেছেন। মুখে কোন তীর্যক মন্তব্য না করলেও ভিতরে ভিতরে মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকুর রহীম আর মুমিনুল হক যে তেতে ছিলেন, তার জ্বলন্ত প্রমাণ মুমিনুলের এমন আবেগময় উচ্ছাস, উল্লাস।
সাবেক কোচের অবহেলা, অনাদরের সমুচিত জবাব দেয়া ছাড়াও আজ শতরানের পর মুমিনুলের আবেগ-উচ্ছাস বেশি থাকার একটা যৌক্তিক কারণও আছে। রান খরায় না ভুগলেও মাঝে চার বছর শতরানের দেখা মেলেনি। সর্বশেষ তিন অংকে পা রেখেছিলেন প্রায় চার বছর আগে ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর।
কাকতালীয়ভাবে শেষ শতরানটাও এই চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২৭১ মিনটে ১৮৯ বলে ১৩ বাউন্ডারিতে ১৩১ রানে ছিলেন নটআউট। তারপর ২৩ ইনিংসে (একবার ব্যাট করেননি) সেঞ্চুরি ছিল না। এর মধ্যে পাঁচবার পঞ্চাশ থেকে আশির ঘরে (৮০, ৬৮, ৬৬, ৬৪ ও ৭৭) পা রাখলেও শতরান করতে পারেননি। সেঞ্চুরি অধরাই ছিল। অবশেষে আজ দুষ্প্রাপ্য হয়ে দাঁড়ানো সেই শতরানের দেখা মিললো তার ব্যাটে।