ভোটের আগে অবকাঠামো ঝলক

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

২ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। আসন্ন স্বাধীনতার মাস মার্চে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উৎক্ষেপণ করা হবে দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। দেশবাসী এখন স্যাটেলাইট মালিক দেশের তালিকায় ৫৭তম অবস্থানে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্তির অপেক্ষায়। এ অপেক্ষাকে আনন্দে রূপ দিতে ১ মার্চ দেশব্যাপী শুরু হবে কাউন্টডাউন উৎসব।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটার টানার অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে পারে এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের টানা দ্বিতীয় সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বছরের প্রথম মাসে। এর আগের নব্বই দিনের মধ্যে হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ক্ষমতাসীন মহাজোটের নির্বাচন প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। সংসদের বাইরে থাকা প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বিভিন্ন ফোরামেও আলোচনা হচ্ছে নির্বাচন নিয়ে। এ অবস্থায় মেয়াদকালের শেষ প্রান্তে এসে অবকাঠামো উন্নয়নের ঝলক দেখাতে চায় সরকার। এরই অংশ হিসেবে বড় আকারের প্রকল্প বাস্তবায়নে দেওয়া হচ্ছে বাড়তি গুরুত্ব।

ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোয় নদীর নিচে সড়ক ও রেল টানেলের গল্প এতদিন ছিল প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে। গল্পকে বাস্তব রূপ দিতে দেশেও এবার নদীর নিচে টানেল তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার টানেল নির্মাণের কাজ চলছে দ্রুত। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এতে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দেবে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ১ হাজার ১০৮ কোটি টাকা ছাড় করেছে। অনেক দেনদরবারের পর অর্থ ছাড় হওয়ায় প্রকল্পে গতি এসেছে। সবকিছু ঠিকভাবে এগোলে ২০২০ সালে এই টানেল নির্মাণের কাজ শেষ হবে। আশা করা হচ্ছে, আগামী ভোটের আগেই প্রকল্পের অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বড় আকারের ১০টি প্রকল্পকে শীর্ষ অগ্রাধিকার ধরে বাস্তবায়ন কার্যক্রম বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এ লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটি। বাস্তবায়ন জোরদার করতে তালিকায় নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি।

কমিটির তদারকিতে বড় প্রকল্পগুলো প্রত্যাশিত গতি পেয়েছে। কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠায় সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থার সহায়তা না নিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সরকার। ইতোমধ্যে প্রকল্পের অর্ধেকের বেশি কাজ হয়েছে বলে ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতুর নদীশাসন কাজ হয়েছে ৩৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। দুই প্রান্তের সংযোগ সড়কের কাজও শেষ। সার্ভিস এরিয়া নির্মাণের কাজ হয়েছে অনেক আগেই। দ্রুত এগিয়ে চলছে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন কাজ। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রতিষ্ঠায় নেওয়া প্রকল্পের কাজও এগিয়ে চলছে বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সর্বশেষ সংশোধনীতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা।

ইআরডির সচিব ও ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেন, ‘ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত মেগা প্রকল্পগুলোর অধিকাংশেরই বাস্তবায়ন অগ্রগতি ভালো। আমরা চেষ্টা করি এসব অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পের বাস্তবায়ন যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়। বড় প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ভালো হচ্ছে বলেই বৈদেশিক অর্থছাড়ও বেশি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) অর্থছাড় হয়েছে ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
গত অর্থবছরের ছয় মাসে ছাড় হয়েছিল ১ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের দ্বিগুণ অর্থ ছাড়ই প্রমাণ করে মেগা প্রকল্পগুলো এগিয়ে যাচ্ছে।’

চীনের অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা থাকলেও পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। গত অর্থবছর অনুমোদন পাওয়া এ প্রকল্পে ২ হাজার ২৪২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। তবে মাঠপর্যায়ে প্রায় ৯ শতাংশ কাজ হয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রায় চার বছর ধরে প্রাথমিক প্রস্তুতির পর পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল পর্বের কাজ সম্প্রতি শুরু হয়েছে। ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকার এ প্রকল্পে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ। রাশিয়ার সঙ্গে দুটি চুক্তির আওতায় এ প্রকল্পের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।

রাজধানীর যানজট নিরসনে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ এখন অনেকটা দৃশ্যমান। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত এলাকায় দিনরাত অবিরাম চলছে প্রকল্পের কাজ। ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৭ লাখ টাকার এ প্রকল্পে ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৮৮১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এ হিসাবে সার্বিক অগ্রগতি ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ।

বিতর্ক-বিরোধিতা থাকলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ১৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৯৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। প্রকল্পের ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে মাঠপর্যায়ে ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার পর পরামর্শকরা কাজ শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে মাটি ভরাটের কাজ শতভাগ, সীমানা প্রাচীর ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে এবং সংযোগ সড়ক ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণের কাজ চলছে।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে রোববার। এর আগেই প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৪ হাজার ৯১৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ের অনুমোদন রয়েছে। এ হিসাবে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরুর আগে প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ১৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ। অবশ্য মাঠপর্যায়ে প্রকল্পের কাজ ১৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ এগিয়েছে বলে জানা গেছে। প্রকল্পের জন্য দেড় হাজার একর জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

গ্যাসের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়লেও উৎপাদন কমছে। এ অবস্থায় শিল্প খাতের প্রয়োজন মেটাতে গ্যাস আমদানির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে। গ্যাস আমদানি নিশ্চিতে মাতারবাড়ীতেই চলছে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণকাজ। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পের জিওটেকনিক্যাল সার্ভের কাজ শুরু হয়েছে। বাণিজ্যিক কাজ আগামী মার্চ মাসে সমাপ্ত হবে। বর্তমানে নকশার কাজ চলছে।

পর্যটন নগরী কক্সবাজারকে রেল সংযোগের আওতায় আনতে রামু থেকে মিয়ানমারের নিকটবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত হচ্ছে রেললাইন। এর অংশ হিসেবে ২০১০ সালে নেওয়া হয়েছিল দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প। দীর্ঘদিন স্থবির থাকা প্রকল্পটি সংশোধনের মাধ্যমে সম্প্রতি গতি আনা হয়েছে। ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকার প্রকল্পে ডিসেম্বর পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৬৬১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। প্রকল্পটির অগ্রগতি ১৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

পটুয়াখালীর পায়রা এলাকা ঘিরে চলছে অবকাঠামো উন্নয়নে বিশাল কর্মযজ্ঞ। এর অংশ হিসেবে সেখানে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ চলছে। ১ হাজার ১২৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকার এ প্রকল্পের আওতায় জমি অধিগ্রহণ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দৃশ্যমান হয়েছে প্রকল্পের প্রাথমিক অবকাঠামোও।