যত বাধাই আসুক, অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগোবে বাংলাদেশ: প্রধানমন্ত্রী

লেখক:
প্রকাশ: ৫ মাস আগে

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে আত্মমর্যাদার ক্ষেত্রে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যত বাধাই আসুক, অপ্রতিরোধ্য গতিতে আমাদের লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে সারা বিশ্বে গর্বের সাথে এগিয়ে যাব।

 

 

শুক্রবার (৫ জুলাই) বিকেলে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সমাপনী উপলক্ষে আয়োজিত সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু দিয়ে সড়কপথে যোগাযোগের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। এর পর ২০২৩ সালে পদ্মা সেতুতে চালু করা হয় রেলপথ।

 

বিশ্ব ব্যাংকসহ চারটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ঋণে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প চূড়ান্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু, দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সংস্থাগুলো। পরে আন্তর্জাতিক আদালতে প্রমাণ হয় যে, এই প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। এরপর বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসার আগ্রহ দেখালেও বঙ্গবন্ধুকন্যা সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করার। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৪ সালের নভেম্বরের শেষদিকে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘টোলের মাধমে যে আয় হয়েছে, সেটা টাকার অঙ্কে বিচার করব না। কারণ, এই সেতু আমাদের গর্বের সেতু, টাকার অঙ্ক দিয়ে বিচার করার নয়। এই একটা সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে অন্তত সেই মর্যাদা দিয়েছে যে, আগে যারা কথায় কথায় আমাদের ওপর খবরদারি করত আর ভাব ছিল যে, এরা ছাড়া বাংলাদেশ চলতেই পারবে না; সেই মানসিকতাটা বদলে গেছে।’

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন বাংলাদেশ শুনলে আন্তর্জাতিকভাবে সবাই সমীহ করে। বাংলাদেশের জনগণ একটা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়নি। আমরা এখন আর্থ-সামজিক উন্নয়নের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ-স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলব।’

তিনি বলেন, এই সেতু নির্মাণের পরে বাংলাদেশের মানুষ এখন গর্ব করে আন্তর্জাতিকভাবে বুক ফুলিয়ে চলতে পারে। যত বাধাই আসুক, অপ্রতিরোধ্য গতিতে আমাদের লাল-সবুজের এই পতাকা নিয়ে সারা বিশ্বে গর্বের সাথে এগিয়ে যাব।

পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক বাধা-বিপত্তি আর ঝড়-ঝঞ্ঝা অতিক্রম করতে হয়েছে, উল্লেখ করে এ সেতুর স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে কৃতজ্ঞ, জনগণের সমর্থন ছিল, আামি এটা করতে পেরেছি। এই সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন হয়েছে।

 

তিনি বলেন, এই সেতু একটা জটিল স্ট্রাকচার। বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদীর একটি হচ্ছে এই পদ্মা নদী। সেই নদীর দুই কূল বেঁধে দেওয়া কঠিন কাজ।

এ সময় পদ্মা সেতু নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকসহ সবাইকে, বিশেষ করে যারা সেতুর জন্য তাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়েছেন, তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।

 

একসময় বিশ্বে অবজ্ঞার চোখে দেখা বাংলাদেশকে আজ সবাই উন্নয়নের রোল মডেল বলছে, এতে শহিদদের যে ত্যাগ, তা সফল হয়েছে বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২০০১ সালে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, গবেষণা এবং ডিজাইনের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, ক্ষমতায় আসতে না পারায় তা থমকে গিয়েছিল।

 

শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুর্ভাগ্যের বিষয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারলে না। কারণ, আমি গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিতে পারিনি। দেশের গ্যাস বিএনপি আমেরিকার কোম্পানিকে দিয়ে দিলো ভারতে বিক্রি করার জন্য। আমি বলেছিলাম, আগে দেখব, কতটুকু গ্যাস আছে। আমার দেশের জনগণের চাহিদা পূরণ করে বাাড়তি থাকলে তা রপ্তানি হবে। এজন্য সরকারে আসতে পারলাম না। বাংলাদেশের সম্পদ বেচে ক্ষমতায় আসতে হবে, শেখ মুজিবের মেয়ে এটা চায় না। আমার বাবা কারো কাছে মাথা নত করেনি, আমিও করি না। খালেদা জিয়া রাজি হয়ে গেলো। ক্ষমতায়ও আসলো।’

তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর ডিজাইন ফাইনাল করলাম, দোতলা সেতু করব। খুবই কঠিন এই নদীতে এই কাজ করা। গাড়ি, মানুষ, রেল সব একসাথে সেতুতে উঠলে, ওজন ধরে রাখা কঠিন কাজ। আমি এই ডিজাইনটা পছন্দ করলাম। বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবি সবাই এগিয়ে আসলো।

বয়সসীমা পেরিয়ে গেলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূস অবৈধভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে থাকা নিয়ে ষড়যন্ত্র করে বিশ্বব্যাংকের টাকা আটকে দেন বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। এজন্য হিলারি ক্লিনটন দুই দফায় ফোন দিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।

‘হিলারি ক্লিনটন ফোন করলেন। ২০ মিনিটে ফোন ছাড়লেন না। দুই বার ফোন দিলেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি আসলো। আমি শুধু বললাম, এই এমডি পদে কী মধু আছে? গ্রামীণ ব্যাংকটা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পরপর। কিন্তু, যখন আইন করে শুরু হলো, তখন এটা এরশাদ সাহেবের আমলে। তখন তিনি একজন এমডি খোঁজ করলেন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রসেফরকে এনে বসানো হলো। সেই প্রফেসর এমডির পদে বসে গ্লুতে এমনভাবে আটকে গেলো যে আর উঠতে চান না।’

বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট যেদিন দায়িত্ব থেকে চলে যান, সেদিনই পদ্মা সেতুর টাকাটা বন্ধ করে দেন, অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এজন্য হিলারি ক্লিনটনের নির্দেশ ছিল। টাকা বন্ধ করার সাথে সাথে অন্যান্য দাতা সংস্থাও বন্ধ করে দিলো। আমি অনেক দেশের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। সবাই মনে করেছিল, বিশ্বব্যাংকের টাকা ছাড়া এই সেতু করাই যাবে না। আমি বললাম, কেন যাবে না? একমাত্র মালেশিয়ার প্রেসিডেন্ট বললেন, আপনার সেতুটা আমি করে দেবো। তারা মোটামুটি একটা প্ল্যানও দিলেন।’

‘মুশকিল হয়ে গেলো আমার দেশে। কেউ বলছে না যে, বিশ্বব্যাংক ছাড়া আমরা করতে পারব। হ্যাঁ আছে, আমার জনগণ আছে, বাংলাদেশের মানুষ আছে। আমাদের দেশে যারা জ্ঞানী-গুণী প্রত্যেকে বলেন, এটা করা সম্ভব না। আমি বলেছি, আমরা করব। ১৭ কোটি মানুষ, টাকা এসে যাবে। আমরা তো এক দিনে সব টাকা খরচ করব না। আমরা আস্তে আস্তে করব।’

পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির প্রমাণ দিতে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ জানানোর কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির প্রমাণ দেখাতে পারে না। জানতে চেয়েছিলাম, দুর্নীতিটা কোথায়, আমি তো কাগজ চাই। কীসের ভিত্তিতে বলেন, দুর্নীতি হয়েছে। প্রমাণ চেয়ে চিঠি পাঠালাম। সেই চিঠির জবাবে বিশ্বব্যাংকের চিঠি পাওয়া গেলো। সেই চিঠিতে ছিল, বিএনপির আমলে একটি সড়কে ও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের টাকা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি বললাম, তখন তো আমি ক্ষমতায় ছিলাম না। এখানে আমার করণীয় কী?

বিশ্বব্যাংকের টাকা দিতে বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক শর্ত দেওয়ার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘তারা বলছে, মন্ত্রীকে জেলে নিতে হবে, মশিউর রহমানকে জেলে দিতে হবে। মামলা করতে হবে। আমি বললাম, কোন অপরাধে মামলা। আমাদের অর্থমন্ত্রী ও উপদেষ্টা এসে আমাকে বললেন যে, ওরা এই শর্ত দিচ্ছে, এটা মানলে টাকা দেবে। আমি বলালাম, ওদের টাকা নেবো না। যেদিন টাকা হবে, সেদিন করবো। তারা বললো, নির্বাচনে কী হবে? আমি বললাম, জনগণ যদি ভোট না দেয়, আমি ক্ষমতায় যাবো না। নিজের আত্মসম্মান বিক্রি করে তাদের শর্ত মেনে টাকা নিতে হবে নাকি? আমি তাদের বলে দিতে বলেছিলাম, এদেশের জনগণের টাকায় পদ্মা সেতু করব। আমি তা করবই।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মনজুর হোসেন। প্রকল্পের বিস্তারিত তুলে ধরেন পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই পদ্মা সেতুর থিম সং প্রচার করা হয়। এছাড়া, পদ্মা সেতুর ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হয়। সুধী সমাবেশে সেতুমন্ত্রী ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা স্মারক ও পদ্মা সেতুর একটি আউটলুক উপহার দেওয়া হয়।