‘গরুর মাংস ৮০০ টাকা কেজি, কিনে খেতে পারছি না। গরিবের মাছ পাঙ্গাস ও তেলাপিয়ার কেজি ২৫০ টাকা। গরিবের ভরসা ছিল ডিম, তাও এখন প্রায় ১৪ টাকা। কী খেয়ে বেঁচে থাকবে গরিব মানুষ। সব জায়গায় সিন্ডিকেট। কেমনে বাঁচব অল্প আয়ের মানুষ। দেখার কি কেউ নেই?’
শুক্রবার (৫ জুলাই) রাজধানীর কাপ্তানবাজারে এ প্রতিবেদককে উল্লিখিত কথাগুলো বলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আবিদ হাসান জয়। শুধু আবিদ হাসান জয় নন, ডিমের দাম বাড়ায় টেনশনে অল্প আয়ের সব মানুষ।
আবিদ হাসান জয় বলেন, অল্প আয়ের মানুষ অনেক আগেই গরুর মাংস ও দামি মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। আমিষের চাহিদা পূরণ করত ডিম ডিম খেয়ে। সেটি নিয়েও চলছে চালবাজি। অনলাইন পত্রিকায় নিউজ দেখলাম, ডিমের উৎপাদনে ঘাটতি নেই। ডিমের সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণ করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। সিন্ডিকেট করে ১০ টাকা ৩০ পয়সায় কেনা ডিম বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৩ টাকা ৭৫ টাকায়। পেঁয়াজ-আলুর মতো এখন ডিম নিয়ে চালবাজি চলছে। সিন্ডিকেট ডিম মজুদ করছে। দাম ঠিক করে দিচ্ছে তারা। পাশের দেশ ভারতে কোনো জিনিসের দাম বাড়লে সরকারি সংস্থাগুলো যেভাবে ব্যবস্থা নেয়, আমাদের দেশের সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সেভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ কারণে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অল্প আয়ের মানুষ খুবই কষ্টে আছে।
তিনি বলেন, বেতন ও ব্যয়ের সাথে মিল নেই। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। কিছু জমা টাকা ছিল, ভেঙে ফেলেছি। এখন কয়েক লাখ টাকা ঋণ। বাজারের যে অবস্থা, ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে হবে।
জয় আরো বলেন, বিভিন্ন জেলায় সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে ডিমের বড় বড় মজুদের খবর বেরিয়ে আসছে। পাইকারি ও খুচরা বাজারেও তদারকি করে পাওয়া যাচ্ছে নানা অনিয়ম ও কারসাজির তথ্য। সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
রাজধানীর কাপ্তানবাজার ও বায়েরবাগ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ফার্মের বাদামি ডিম প্রতি ডজন ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হালি ৫৫ টাকা। প্রতিটি ডিমের দাম পড়ছে ১৩ টাকা ৭৫ পয়সা। অথচ ফার্ম থেকে প্রতিটি ডিম ১০ টাকা ৩০ পয়সায় সংগ্রহ করা হচ্ছে। ডজন হিসাবে ডিমের ক্রয়মূল্য পড়ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। অর্থাৎ খুচরা বাজারে এসে প্রতি ডজন ডিমে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা দাম বেড়ে যাচ্ছে।
রাজধানীর কাপ্তান বাজারের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণে একটি সিন্ডিকেট আছে। ব্যবসায়ী সমিতিগুলোর কিছু অসাধু নেতা কম দামে ডিম কিনে মজুদ করে। দেশজুড়ে আছে তাদের সিন্ডিকেট। তারা মোবাইল ফোনে কল করে কিংবা এসএমএস দিয়ে দাম জানিয়ে দেয়। সেই দামে সবাই বিক্রি করে। এই সিন্ডিকেটের কারণে সঠিক দাম পাচ্ছেন না খামারিরা এবং ভোক্তারাও বেশি দামে ডিম কিনছেন। তেজগাঁওয়ের ডিম ব্যবসায়ী সমিতি এখনো ডিমের দাম নির্ধারণ করে এসএমএস ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বার্তা পাঠাচ্ছে। সে অনুযায়ী অন্যান্য সমিতি ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, দেশে বর্তমানে কোনো ব্যবসাই সিন্ডিকেটের বাইরে নেই। একেক সময় একেক সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে ভোক্তাদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। চাল-চিনি থেকে শুরু করে ডিম-মাংসসহ—কোনো ব্যবসাই এখন আর সিন্ডিকেটের বাইরে নেই। এছাড়া হাতবদল হয়েও পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই, ক্যাব মনে করে, জনদুর্ভোগ কমাতে অবৈধ সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অতি দ্রুত নিতে হবে।
তিনি বলেন,কারসাজিকারীরা চিহ্নিত হলেও তাদের দেওয়া হয় লঘু দণ্ড। সম্প্রতি আড়াই লাখ ডিমের মজুদ উদ্ধারের পর জরিমানা করা হয় শুধু ৩০ হাজার টাকা। যে জরিমানা করা হয়, তাতে অসাধু ব্যবসায়ীদের কিছু যায় আসে না। লঘু দণ্ডের কারণে অপরাধীরা বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে। এর ফলে কারসাজির প্রবণতাও বাড়ছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণে সমিতিগুলো সক্রিয়। আমরা ব্যবসায়ীদের কাছে যে দামে বিক্রি করি, তাতে প্রতিটি ডিম ১২ টাকায় বেচলেই তাদের অনেক লাভ হয়। বাজার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে উৎপাদন পর্যায়ে যে অতিরিক্ত খরচ গুনতে হচ্ছে, সেদিকে সরকারের সংস্থাগুলোর নজর দেওয়া প্রয়োজন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ঢাকা থেকে মোবাইলে ক্ষুদে বার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ হয় সারাদেশের ডিমের বাজার। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বারবার ডিমের দাম বেড়ে যায়। রাত ৩টার সময় এসএমএসের মাধ্যমে সারা দেশে ডিমের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে অধিদপ্তরের কাছে। যদি অবিলম্বে এ ধরনের কারসাজি বন্ধ না করা হয়, তাহলে যেসব প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে জড়িত, সবগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। অনেক উপর লেভেল থেকেও এদেরকে ছাড় না দেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা আছে। যে কোনো মূল্যে এই সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে। কয়েকদিনের মধ্যে ডিমের দাম ডজন প্রতি ১৪০ টাকায় নেমে আসবে বলে আশা করছি।
উল্লেখ্য, গত ৩ জুলাই বরিশাল নগরীর নিউ হাটখোলা এলাকার একটি লাইসেন্সবিহীন হিমাগার থেকে অবৈধভাবে মজুদ করা প্রায় আড়াই লাখ ডিম জব্দ করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অভিযানে ৬ জন ব্যবসায়ীকে ৫ হাজার করে মোট ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। লাইসেন্স না থাকায় হিমাগারকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সেই সঙ্গে ডিমগুলো ৫ দিনের মধ্যে ক্রয়মূল্যে বাজারজাত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কাছাকাছি সময়ে নরসিংদী জেলার সদর উপজেলার এক হিমাগারে ১৪ লাখ এবং কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার আরেক হিমাগারে ২৮ লাখ ডিম মজুদের সন্ধান পায় সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা।