চরাঞ্চলের নিম্নবিত্ত একটি কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠা উম্মে হানী যুথির (১৮)। বাবার কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল সাত সদস্যর পরিবার। ছোটবেলা থেকেই যুথির স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ায়। আর্থিক টানাপোড়নের সংসারে মেয়ের স্বপ্ন পূরণে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন বাবা-মাও। পরিবারের সহযোগিতা আর কঠোর অধ্যবসায় যুথিকে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। পেয়েছেন মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ। তার এমন অভাবনীয় সাফল্যে খুশি পরিবার, শিক্ষক ও এলাকাবাসী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উম্মে হানী যুথির বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলা ও সখিপুর থানার চরকুমারিয়া ইউনিয়নের লালু বেপারী কান্দি এলাকায়। বাবা হাবিব মালত পেশায় একজন কৃষক। মা হাফেজা বেগম একজন গৃহিণী।
পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে যুথি মেজো। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ মেধাবী তিনি। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় স্থানীয় খাস গাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এরপর ২০২১ সালে চরকুমারিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যুথি এ সাফল্য ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখেন উচ্চ মাধ্যমিকেও। ২০২৩ সালে লালমাটিয়া মহিলা কলেজে থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে জিপিএ-৫ পান।
শিক্ষাজীবনে বৃত্তিসহ বিভিন্ন মেধা নির্বাচনী পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জন করেন উম্মে হানী যুথি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর শুরু হয় তার স্বপ্ন ছোঁয়ার লড়াই। দিনরাত এক করে শুরু করেন পড়াশোনা। চিকিৎসক হতে অংশ নেন মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায়। টিকেও যান তিনি। এমবিবিএস পরীক্ষার মেধা তালিকায় তিন হাজার ১৪৫তম স্থানে জায়গা করে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যান ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
বাড়িতে গিয়ে কথা হয় উম্মে হানী যুথির সাথে। যুথি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই বাবাকে দেখতাম ভীষণ পরিশ্রম করতে। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমাদের পড়াশোনার খরচ চালাতেন। তখন থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাবার যোগ্য মেয়ে হয়ে উঠবো। উনার এই পরিশ্রম বৃথা যেতে দেবো না। সেই সময় থেকে স্বপ্ন দেখতাম চিকিৎসক হওয়ার।’
নিজের এ সাফল্যের পেছনে পরিবারের অবদান তুলে ধরে যুথি বলেন, ‘বাবার পাশাপাশি আমার মাও আমাদের জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন। তিনি আমাদের পড়াশোনা চালাতে বাড়তি আয়ের জন্য বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করতেন। যখন আমাদের বইয়ের দরকার হতো মা তার হাঁস, মুরগি, ডিম বিক্রি করে নতুন বই কিনে দিতেন। তাদের এ ত্যাগ আমাকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তুলেছে।’
‘আমি আরও নতুন উদ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। পড়াশোনার বাইরে যতটুকু সময় পেয়েছি বাবা-মাকে সাহায্য করতাম। মাকে রান্নার কাজে সহযোগিতা করা, থালাবাসন ধুয়ে দেওয়া, গরুর খাবারের জন্য বাবাকে টিউবওয়েল থেকে পানি তুলে দিতাম’, যোগ করেন মেডিকেলে চান্স পাওয়া উম্মে হানী যুথি।
পড়াশোনা শেষ করে একজন আদর্শ চিকিৎসক হিসেবে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চান অদম্য এ তরুণী। তিনি বলেন, ‘আমাদের চরাঞ্চলে বেশিরভাগ মানুষ নিম্নআয়ের, যারা প্রধানত কৃষিনির্ভর। তাদের পক্ষে ভালো চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। আমি চাই একজন ভালো চিকিৎসক হয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে।’
মেয়ের এমন সাফল্যে বেজায় খুশি বাবা হাবিব মালত ও মা হাফেজা বেগম। হাবিব মালত বলেন, ‘কৃষিকাজ করে অনেক কষ্ট করে মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছি। যখনই শুনেছি আমার মেয়ে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে, মেয়ের সাফল্যে তখনই সব কষ্ট ভুলে গেছি। সবাই আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবেন। ও যেন ডাক্তার হয়ে এলাকার সাধারণ মানুষের সেবা করতে পারে।’
মা হাফেজা বেগম বলেন, ‘সবসময় মেয়েদের সময় দিয়েছি। ওদের পড়াশোনায় যাতে কষ্ট না হয়, ভোরে উঠে ওদের রান্না করে দিতাম। সেই খাবার খেয়ে ওরা পড়তে যেতো। সবসময় খেয়াল রাখতাম ওরা ঠিকঠাক পড়াশোনা করছে কি না। সেই শাসন আজ কাজে লেগেছে। আমার মেয়ে আজ মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।’
চরকুমারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জসিমউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘উম্মে হানী যুথি স্কুলজীবন থেকেই ভীষণ মেধাবী। ও আমাদের এই প্রতিষ্ঠান থেকে মাধ্যমিকে এ প্লাস পেয়েছে। এবছর মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। আমরা শিক্ষক হিসেবে ওকে নিয়ে গর্বিত।’
ভেদরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বলেন, ‘যুথি এক সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান। সে মেডিকেল কলেজে চান্স পাওয়ায় আমি ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ খুশি। আমি চাই সে যেন চিকিৎসক হয়ে দেশের মানুষের সেবা করতে পারে।’