টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি বাংলাদেশে নয়, বরং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বলে দাবি করেছে দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। ২ জানুয়ারি নিজেদের জিওগ্র্যাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা জিআই পণ্য হিসেবেও এ শাড়িকে স্বীকৃতি দিয়েছে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। এরপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানিয়েছেন টাঙ্গাইলের ব্যবসায়ী ও সুধীজনেরা। ইতোমধ্যে টাঙ্গাইলের সচেতন মহল মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। দ্রুত ভারতের জিআই বাতিল করে বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই স্বীকৃতির দাবি তাদের। এ বিষয়ে জরুরি সভা ও মন্ত্রণালয়ে কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
প্রসঙ্গত, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে জিআই পণ্য। তাই কোনও একটি পণ্যকে এর তালিকাভুক্ত করতে মুখিয়ে থাকে দেশগুলো। কিন্তু জটিলতা বাঁধে, যখন একই পণ্যকে একাধিক দেশ নিজেদের বলে দাবি করে।
এর আগে, বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) ভারতের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জানানো হয়, টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত একটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর মিহি গঠন, বৈচিত্র্যময় রং এবং সূক্ষ্ম জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত। এটি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। টাঙ্গাইলের প্রতিটি শাড়ি ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে দক্ষ কারুকার্যের নিদর্শন।
এরপর থেকে টাঙ্গাইলসহ সারাদেশে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। গবেষকদের মতে, টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি বাংলাদেশে। এর নামের মধ্য দিয়েই তা উঠে এসেছে। ইতিহাসও টাঙ্গাইল শাড়িকে বাংলাদেশের বলে সাক্ষী দেয়। যে কোনো স্থানের ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে সেখানকার সাংস্কৃতিক ইতিহাস গড়ে ওঠে। টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাসটিও তাই। বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ হওয়ায় টাঙ্গাইলের ছেলেরা পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে লুঙ্গি-গামছা। এ অঞ্চলের মেয়েরা পরিধান করে শাড়ি, যা টাঙ্গাইল শাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়েছে। টাঙ্গাইল অঞ্চলটি যখন থেকে গড়ে ওঠে তখন থেকেই এ শাড়ি তৈরি শুরু হয়। এ শাড়ির নাম থেকেই এর উৎপত্তি বোঝা যায়।
টাঙ্গাইল শাড়ির সঙ্গে জড়িতরা জানান, প্রায় ২০০ বছর ধরে ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি। যা নিজস্ব ঐতিহ্য বহন করে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সুনাম কুড়িয়েছে। এ ছাড়াও টাঙ্গাইলের একটি স্লোগান রয়েছে ‘নদী চর খাল বিল গজারির বন, টাঙ্গাইল শাড়ি তার গর্বের ধন’। টাঙ্গাইল শাড়ি সদর উপজেলার বাজিতপুর, কৃষ্ণপুর, দেলদুয়ারের পাথরাইল, কালিহাতীর বল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদন হয়। তবে, দেলদুয়ারের পাথরাইল টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী হিসেবে খ্যাত।
শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে জিআই স্বীকৃতির দাবিতে মানববন্ধন করেছে স্থানীয় সচেতন নাগরিক সমাজ। এতে বক্তব্য রাখেন শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুঈদ হাসান তড়িৎ, সমাজকর্মী নাদিউর রহমান আকাশ, আহসান খান আকাশ, মির্জা রিয়ান প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ি। ভারতীয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল পেজে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত একটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস’ পোস্টের তীব্র নিন্দা জানাই। সেই সাথে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বর্তমান সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন আন্দোলনকারীরা।
বাংলাদেশের বেশকিছু পণ্যের জনপ্রিয়তা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছে বিদেশের মাটিতে। বিশেষ করে অবস্থানের কারণে পেয়েছে জিআই স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতি থাকা পণ্যটি দেশের পাশাপাশি বিদেশের বাজারেও আধিপত্য করে বেড়ায়। অন্যদিকে, সফট পাওয়ার (প্রভাব বিস্তারক) হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরে। বাণিজ্যিক সুবিধা পাওয়া তখন সহজ হয়।
টাঙ্গাইলের শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ি বলতে টাঙ্গাইলকেই বোঝায়। টাঙ্গাইলের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ভিন্ন মান ও দক্ষতায় টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদন হয়। এ দক্ষতায় অন্য জায়গায় তৈরি হলেও সেটা টাঙ্গাইল শাড়ি নয়। অন্যরা টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজের দাবি করে জিআই ট্যাগ নেওয়া, এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক। এর প্রতিবাদ জানাই। এর বিরুদ্ধে সকলকে সোচ্চার হতে হবে।
টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগারের সাধারণ সম্পাদক কবি মাহমুদ কামাল বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের একটি জেলা টাঙ্গাইল। কয়েক শ’ বছর আগে থেকে টাঙ্গাইল শাড়ি পৃথিবী-বিখ্যাত। সেটি অন্য দেশের জিআই পণ্য হিসেবে কীভাবে স্বীকৃতি পায়, সেটি আমি বুঝতে পারছি না। সেটি বাতিল করে বাংলাদেশ পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানাই।
জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম জানান, টাঙ্গাইল শাড়ি, মধুপুরের আনারস ও জামুর্কির সন্দেশ জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে আমরা আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এটা যে এখানকার অর্জিন, সেটার ৫০ বছরের সুদীর্ঘ ধারাবাহিকতা দিতে হয়। অথচ, টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি আড়াই শ’ বছরের পুরাতন। অবশ্যই আমরা আশাবাদী, এটির জিআই পণ্যের স্বীকৃতি আমরা পাব।
তিনি আরও বলেন, ভারত যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তারা ডকুমেন্টেশনে উল্লেখ করেছেন, পাথরাইলের বসাক পরিবারের আদি পুরুষরা সেখানে গিয়ে তাঁত শাড়ির একটা ভিন্ন প্রকার উদ্ভাবন করেছে পাড়ের ডিজাইন চেঞ্জ করে। আমাদের পদক্ষেপের বিষয়ে আমরা স্টাডি শুরু করেছি। জরুরি সভা করেছি এ বিষয়ে কীভাবে আবেদন করা যায়। মন্ত্রণালয় টু মন্ত্রণালয় কথা বলে, এছাড়াও আপিল করার সুযোগ থাকলে সে বিষয়েও আমরা কথা বলব।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বসাক সম্প্রদায় হচ্ছে টাঙ্গাইলের আদি তাঁতি। দেশ ভাগের আগে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির বাজার বসত কলকাতায়। দেশ ভাগের পর তা বসে টাঙ্গাইলের বাজিতপুরে। অন্যদিকে, বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণ কাহিনীতে টাঙ্গাইলের বস্ত্র শিল্প অর্থাৎ তাঁত শিল্পের উল্লেখ রয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশে প্রথম পর্যায়ে জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে জামদানি। তারপর একে একে আসে ইলিশ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম, মসলিন, বাগদা চিংড়ি, কালিজিরা চাল, বিজয়পুরের সাদা মাটি, রাজশাহী সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম। গত আট বছরে মোট ২১ পণ্য জিআইয়ের স্বীকৃতি পেয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল প্রপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) সংজ্ঞা অনুসারে, জিআই বলতে কোনও পণ্যের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান, নাম বা চিহ্নকে বোঝায়। ভৌগোলিক কারণে সে পণ্যের আলাদা গুণ ও খ্যাতি থাকতে হয়। যেহেতু এর গুণাগুণ ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে, কাজেই পণ্য ও এর উৎপত্তিস্থলের মধ্যে সুস্পষ্ট সম্পর্ক থাকে।
যেসব পণ্য বাংলাদেশে জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে একই ধরনের কিছু পণ্য ভারতও স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্যে নকশিকাঁথা, জামদানি ও ফজলি আম উল্লেখযোগ্য। এ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনও ধরনের প্রতিক্রিয়া এর আগে জানানো হয়নি।