ভোরের দিকে ট্রেনে হঠাৎ আগুন দেখে বড় ভাগনে ফাহিম আহমেদকে (৬) নিয়ে নিচে ঝাঁপ দেন হাবিব। ঝাঁপ দেওয়ার আগে বোনকে বলেন পেছনের দিক দিয়ে দ্রুত নেমে যেতে। পরে পেছনে ফিরে দেখেন, বোন আর ছোট ভাগনে আটকা পড়েছেন ট্রেনে। এরপরও বোন ও ভাগনেকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন হাবিব। কিন্তু উপস্থিত লোকজনের জন্য পারেননি। চোখের সামনেই বোন নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও ভাগনে ইয়াসিন আরাফাতকে (৩) পুড়ে মরতে দেখেন হাবিব।
মোবাইলে এতথ্য জানান ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে ফেরা হাবিবুর রহমান হাবিব। দুই ভাগনে আর বোনকে নিয়ে ট্রেনে করে সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি।
পপির বাড়ি নেত্রকোনা সদরের দক্ষিণ বিশিউড়া ইউনিয়নের বরুনা গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের আব্দুল মজিদের ছেলে মিজানুর রহমানের স্ত্রী। তার স্বামী মিজান ঢাকার কারওয়ান বাজারে হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করেন।
পপির ভাই ও দুই সন্তানকে নিয়ে ট্রেনে করে নেত্রকোনা থেকে স্বামীর কর্মস্থলে ফিরছিলেন। এসময় তারা মোট ৯ জন ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। আগের স্টেশনে পাঁচজন নেমে যান।
নেত্রকোনা থেকে ছেড়ে যাওয়া মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মা-ছেলেসহ চারজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ভোর ৫টার তেজগাঁও স্টেশনে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে দুজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা হলেন নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তার ছেলে ইয়াসিন আরাফাত (৩)। বাকি দুজনের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। তাদের বয়স আনুমানিক ৩০-৪০ বছর।
নিহত পপির ভাই হাবিবুর রহমান জানান, ঢাকার তেজগাঁও তেজতুরী বাজার এলাকায় তারা থাকেন। গত ৩ ডিসেম্বর তারা বেড়ানোর উদ্দেশ্যে নেত্রকোনার গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই সোমবার রাত ১২টার দিকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস করে নেত্রকোনা বড় স্টেশন থেকে ঢাকায় ফিরতে রওয়ানা দিয়েছিলেন। ভোরে তাদের ঢাকায় পৌঁছানোর কথা ছিল।
হাবিবুর রহমান জানান, তেজগাঁও স্টেশন এসে ট্রেনটি থামলে তাদের পাঁচ যাত্রী সেখানে নেমে যান। এসময় তাদের পেছনের ছিটে থাকা দুই ব্যক্তিও নেমে যান। এরপর ট্রেনটা চলতে শুরু করা মাত্রই পেছনের সিট থেকে আগুন জ্বলে ওঠে। মুহূর্তেই আগুন পুরো বগিতে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে দৌড়ে তিনি ফাহিমকে নিয়ে ট্রেন থেকে নামতে পারলেও ভেতরে আটকা পড়েন ছোট ইয়াসিন ও তার মা নাদিরা। তাদের আর কোনোভাবেই বের করতে পারেননি। পরে ফায়ার সার্ভিস তাদের মরদেহ বের করে।
জেলার পূর্বধলা উপজেলার বৈরাটি ইউনিয়নের আলমপুর গ্রামের বাসিন্দা পপির বাবা ফজল হক বলেন, ‘আমার মেয়ে-নাতিকে কেন মারা হলো, কী অপরাধ আমার সন্তানের, কার জন্য আমার এই ক্ষতি করা হলো, এর বিচার কে করবে, কার কাছে আমি বিচার চাইবো, তিন বছরের নিষ্পাপ শিশুটিকে আগুনে পুড়িয়ে কেন হত্যা করা হলো? আমি আল্লাহর কাছে এর বিচার চাই।’
পপির শাশুড়ি মেহেরুন নেসা ও চাচা শ্বশুর আব্দুল কাদির মিলন বলেন, ‘আমরা এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
এ বিষয়ে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘ট্রেনটি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকার কমলাপুরে আসছিল। বিমানবন্দর স্টেশন পার হওয়ার পর খিলক্ষেত এলাকায় পৌঁছালে যাত্রীরা পেছনের বগিতে আগুন দেখতে পান। পরে তারা চিৎকার করতে থাকেন। এরপর চালক ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে থামান।’
নিহতের স্বজনদের বরাত দিয়ে নেত্রকোনার পুলিশ সুপার ফয়েজ আহমেদ বলেন, এ ঘটনায় নিহত তিন ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন শহরের নাগড়া এলাকার মুদি ব্যবসায়ী রশিদ ঢালিসহ (৬২) সদরের মা ও ছেলে।