ভারতের মাটিতে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা উচিয়ে ধরার আগে অস্ট্রেলিয়া সবশেষ শিরোপা জিতেছিল ২০১৫ সালে, মাইকেল ক্লার্কের নেতৃত্বে। সেই দলেও প্যাট কামিন্সও ছিলেন। তবে আজকের পরিণত কামিন্স নয়, বছর বাইশের এক তরুণ। যার চোখেমুখে ঝিলিক দিয়েছিল স্বপ্নীল এক পথ যাত্রার আশা। তবে কামিন্স অতোদূর ভাবেননি। অথচ সেই কামিন্সই এখন বিশ্বজয়ী অধিনায়ক।
রিকি পন্টিং-মাইকেল ক্লার্কদের রাজত্বে একটা সিংহাসন এখন কামিন্সেরও দখল। তবে একটা দিক দিয়ে এই পেসার এগিয়ে। যেখানে তার রাজত্বে তিনিই সম্রাট। টেস্ট ও ওয়ানডের দুই বিশ্ব আসর আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ও ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কদের কাতারে কামিন্স ছাড়া আর কেউ নেই।
কামিন্স জাত অস্ট্রেলিয়ানদের মতো অধিনায়ক নন। ডাকাবুকো মনোভাব কিংবা ঠিক অধিনায়ক সুলভ আচরণ তার মাঝে নেই। তার ওপর ফাস্ট বোলাররা দলনেতা হিসেবে আদর্শ নন বলে অজিদের ইতিহাসে একটা প্রথা আছে। সেদিক দিয়েও উতরে গেছেন কামিন্স। তিনিই প্রথম জেনুইন ফাস্ট বোলার, যিনি নিয়মিত অধিনায়ক হয়েছেন।
অবশ্য শুরুতে পাঁচটা বিশ্বকাপজয়ী দলের ভার নিতে চাননি কামিন্স। এমনিতেই তার কাঁধে ছিল সাদা পোশাকের ঐতিহ্য ধরে রাখার গুরুদায়িত্ব। তার ওপর ওয়ানডেতে এমন আহামরি পারফরম্যান্স তার ছিলো না। তবে হঠাৎ করেই অ্যারন ফিঞ্চ সরে যাওয়ায় কামিন্সকে অনেকটা বাধ্য হয়েই ওয়ানডের নেতৃত্ব দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। দুই ফরম্যাটের গুরুদায়িত্ব পেয়ে কামিন্স লক্ষ্য ঠিক করে ফেললেন। আইপিএলের লোভনীয় হাতছানিকে তাড়িয়ে দিলেন মাছির মতো!
প্রতিদান পেতে শুরু করলেন অ্যাশেজে। ইংল্যান্ডের ‘বাজবল’কে উড়িয়ে দিলেন আপন মন্ত্রণায়। তবে ওয়ানডেতে ঠিক সেটেল হতে পারছিলেন না। এমনিতেই চাপের ভার, তার উপর চোট-বিশ্রাম-বিরতি। একপর্যায়ে কামিন্স বলেই ফেললেন, তিনি ওয়ানডেতে নিজের অধিনায়কত্ব নিয়ে নিশ্চিত নন। তবে নিশ্চিত ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাচক সাবেক ক্রিকেটার জর্জ বেইলি। যে কারণেই কিনা মাত্র চার ওয়ানডেতে দলকে নেতৃত্ব দেওয়া কামিন্সকে নেতা করে দল পাঠালেন ভারতে।
এক বছরের গ্যাপ। মাঠের ঘাসের চরিত্রটাই কামিন্সের ধরতে পারার কথা না। বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচেও দেখা গেল সেটা। প্রথম ম্যাচে ভারতের কাছে হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে স্রেফ বিধ্বস্ত হয় অস্ট্রেলিয়া। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় দিয়ে সূচনার শুরু। ব্যস, পরের পথটায় আর পরাজয়ের গল্প নেই।
অস্ট্রেলিয়ার প্রথাগত ধারাটা পেয়ে গেল প্যাট কামিন্সের দল। বিশ্বমঞ্চে একবার জয়ের স্বাদ পেয়ে গেলে অস্ট্রেলিয়াকে আটকানো কঠিন। হয়েছেও সেটা। টানা সাত জয়ে সেমি-ফাইনালে ওঠা অস্ট্রেলিয়া শেষ চারে গুঁড়িয়ে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। দল পৌছে যায় স্বপ্নের ফাইনালে। ফাইনালে ওঠা অধিনায়কের একটু হলেও তো কৃতিত্ব প্রাপ্য! কিন্তু সেটা নিতে নারাজ কামিন্স। তিনি কেবল নেতা হয়ে চ্যালেঞ্জ জয় করতে চেয়েছেন।
সেই চ্যালেঞ্জ জয়ের পথে ফাইনালে উইকেট ও কন্ডিশন পড়া থেকে শুরু করে বোলারদের তিনি যেভাবে ব্যবহার করেছেন, মাঠে ফিল্ডিং সেট করেছেন তা এক কথায় চোখধাঁধানো। এরপর নিজের কাজটুকুও করলেন। শ্রেয়াস আইয়ারকে বিদায় করার পর কোহলিকেও ফিরিয়ে ১ লাখ ৩২ হাজার দর্শককে স্রেফ চুপসে দেন অজি দলপতি। যেমন বলেছিলেন, ‘বিশাল সংখ্যক দর্শককে চুপ করিয়ে দিতে পারার চেয়ে তৃপ্তিদায়ক কিছু খেলাধুলায় আর নেই। আগামীকাল (ফাইনালে) এটিই আমাদের লক্ষ্য।’
দেড়’শ কোটি মানুষের ভারতকে কামিন্স চুপসে দিয়েছেন। নেতৃত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা তার হাত ধরেই আহমেদাবাদের সাবারমাতি নদী পেরিয়ে আরব সমুদ্র হয়ে সোনালী ট্রফিটা যাচ্ছে তাসমান সাগরপাড়ে। কামিন্সও ওই ট্রফিটার মতোন। অমরত্ব চান না, কেবল হলদে গন্ধরাজ হয়ে সুবাস ছড়িয়ে যেতে চান, প্রত্যাশাটুকু মিটিয়ে দেশকে তৃপ্তি দিতে চান, নিজেও আনন্দে ভাসতে চান, ভাসাতে চান।