আজিজুর রহমান একজন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। কর্মস্থল সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলা। কিন্তু তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানী ঢাকায়। ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ কালীগঞ্জে যোগদান করলেও নিয়মিত অফিস করেন না। মাসে দুই থেকে তিন দিন কেবল যান এবং সেটা করেন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বোর্ড কিংবা ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে উপস্থিত থাকতে। আর তাঁর যাতায়াতও বিলাসিতায় পূর্ণ। ঢাকা থেকে বিমানে যশোর। সেখান থেকে ভাড়া করা মাইক্রোবাসে কালীগঞ্জ। সেদিনই আবার সন্ধ্যা বা রাতের ফ্লাইটে ফেরেন ঢাকায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য ও এমপিওভুক্তির নামে মোটা অঙ্কের টাকা পকেটে পুরছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আজিজুর রহমান কিরণ। তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকেন না, পরীক্ষার কেন্দ্রে দায়িত্ব দেওয়া হলেও পালন করেন না। সাম্প্রতিক বই উৎসবেও তিনি উপস্থিত ছিলেন না।
আজিজুরের নিয়মিত অফিসে না থাকা, শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য, বিমানে যাতায়াত করাসহ নানা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়। তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও স্থানীয় দুজন এমপি লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন। তবু অজ্ঞাত খুঁটির জোরে তিনি অফিস না করেই নিয়মিত বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন। স্থানীয় কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁর বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম সাইদুর রহমান বলেন, ‘আজিজুরের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে নানা অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে প্রমাণ পাওয়া গেছে। পরে তাঁকে শোকজ করা হয়। এমনকি লিখিতভাবে বিষয়গুলো শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকেও জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘তিনি শিক্ষক নিয়োগ কিংবা ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনের দিন বেশি উপস্থিত থাকেন। আর ঢাকা থেকে বিমানে এসে অফিস করেন। সেটা মাসে দুই থেকে তিন দিন। এমন একজন কর্মকর্তাকে নিয়ে আমরা বিপাকে আছি।’
অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, নিয়মিত অফিসে কিংবা সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকলেও শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানিজিং কমিটির নির্বাচনে তিনি ঠিকই উপস্থিত থাকেন। ঢাকা থেকে একজন কর্মকর্তা সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে কিভাবে অফিস করেন—এ প্রশ্নের উত্তর যেকোনো শিক্ষকই একবাক্যে বলে দিতে পারবেন। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন বড় কর্মকর্তার সঙ্গে রয়েছে আজিজুর রহমানের ভালো সম্পর্ক। সেই কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা দিয়েই দিনের পর দিন এভাবে কর্মস্থলে দুই-এক দিন অফিস করেই বেতন-ভাতা উত্তোলন করে যাচ্ছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটি ইউনেসকোর ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্তির পর বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় সরকারিভাবে তা উদ্যাপনের নির্দেশ দেওয়া হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে তা পালন করার দিনও উপস্থিত ছিলেন না আজিজুর। গত ১৫ আগস্ট শোক দিবসের অনুষ্ঠানেও তিনি উপস্থিত ছিলেন না। সর্বশেষ কালীগঞ্জ উপজেলায় বই উৎসবে সংসদ সদস্য আ ফ ম রুহুল হক ও এস এম জগলুল হায়দারসহ প্রশাসনের দায়িত্বশীল সবাই উপস্থিত থাকলেও আজিজুর ছিলেন না। এভাবে একের পর এক সরকারি আদেশ না মানায় আজিজুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানান খুলনা অঞ্চলের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের উপপরিচালক অধ্যাপক টি এস জাকির হোসেন।
সম্প্রতি কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম মাঈনউদ্দিন হাসান জেডিসি পরীক্ষাকেন্দ্রের দায়িত্ব দেন আজিজুর রহমানকে। উপজেলার নলতা আহসানিয়া দারুল উলুম আলিম মাদরাসায় কেন্দ্রের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। এতে ওই কেন্দ্রে ব্যাপকভাবে নকল করার সুযোগ পেয়ে যায় অনেক শিক্ষার্থী। নকলের অভিযোগে ওই দিন পাঁচ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারও করা হয়। পরে ওই কেন্দ্রে উপজেলা মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ওমর ফারুককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অভিযোগ উঠেছে, আগামী ২২ জানুয়ারি উপজেলার তারালী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করেছেন আজিজুর। সরস্বতী পূজা ওই তারিখে পড়ার কারণে সনাতন ধর্মের কয়েকজন নিয়োগ পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানালেও তিনি সেটা রাখেননি। শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, সরকারি কার্যদিবসে অফিস না করলেও স্কুলে সরকারি বন্ধের তারিখে তিনি নিয়োগ পরীক্ষার দিন ধার্য করেছেন। ধর্মীয় বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেননি। ওই নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি উপস্থিত থাকবেন বলে জানিয়ে গেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, উপজেলার হিসাবরক্ষণ বিভাগের একজন কর্মকর্তা ও একজন নৈশপ্রহরী আজিজুরের অপকর্মের অন্যতম সহযোগী। আজিজুরের স্ক্যান করা স্বাক্ষর দিয়ে তাঁর দপ্তরের বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করা হয়। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, স্যার মাসে যে দুই-এক দিন অফিস করেন, সেটা স্বার্থের কারণেই করেন। নিয়োগ বোর্ডে উপস্থিত থাকেন নিজের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে।
কালীগঞ্জ উপজেলা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে যোগদান করার পর মাসে তিন দিনের বেশি অফিস করেননি। আর ঢাকা থেকে বিমানের ফ্লাইটে আসেন যশোরে। সেখানে রিজার্ভ করা মাইক্রোবাস অপেক্ষায় থাকে। সেটা দিয়ে তিনি কালীগঞ্জ আসেন। যতবার তিনি সাতক্ষীরা আসেন, বিমানেই আসেন। আর বিশেষ করে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়েই তিনি কালীগঞ্জ আসেন।’
সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এস এম জগলুল হায়দার বলেন, ‘খুবই খারাপ লোক। টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। নিয়মিত অফিস না করেই মাসের পর মাস পার করছেন। বঙ্গবন্ধুর কোনো কর্মসূচিতেও তিনি উপস্থিত ছিলেন না।’
এসব প্রসঙ্গে জানতে আজিজুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘অভিযোগ সব মিথ্যা। ভাই, যদি আমার অফিসে আসতেন, তাহলে একটু চা খেতে খেতে কথা বলতাম।’ অফিসে নিয়মিত না যাওয়া এবং বিমানে যাতায়াত প্রসঙ্গ তুললে বলেন, ‘আমি এখন ব্যস্ত, ওই বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।’