‘আমি এহন মাদরাসায় যামু ক্যামনে? আমারে মেম্বারে মিথ্যা অপবাদ দিয়া হগুলডির (সবার) সামনে জোতা (জুতা) দিয়া পিডাইছে। আমার এহন ডর করে। রাস্তায় যদি মেম্বারে আবার আমারে মারে!’ কথাগুলো বলছিল পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার মাদরাসা পড়ুয়া সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রী।
গত ১০ জুন রাত ৮টার দিকে প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফেরার পথে শ্লীলতাহানির শিকার হয় ওই ছাত্রী। এসময় ছাত্রীর ভগ্নিপতি তাকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে যান। পরদিন (১১ জুন) সকালে গোলখালী ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যসহ স্থানীয় যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতারা সালিশ বসিয়ে ছাত্রী ও তার ভগ্নিপতির কোনো কথা না শুনেই তাকে জুতাপেটা করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিজ্ঞাপন
এ ঘটনায় ছাত্রীর বাবা মো. হেলাল হাওলাদার বাদী হয়ে পটুয়াখালী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন, যা বুধবার (২১ জুন) শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেছেন আদালত।
এদিকে, পুলিশের পক্ষ থেকেও ঘটনার তদন্ত করার কথা জানিয়েছেন গলাচিপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শোনিত কুমার গায়েন।
ভুক্তভোগীর বাবা এবং এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ওই ছাত্রী স্থানীয় একটি মাদরাসার সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। প্রতিদিনের মতো গত ১০ জুন বাড়ির পাশে সন্ধ্যায় প্রাইভেট পড়তে যায়। সেখান থেকে ফেরার পথে একই এলাকার মেনাজ প্যাদার ছেলে হানিফ প্যাদা (৪০) তাকে একা পেয়ে মুখ চেপে ধরে রাস্তার পাশে ঝোপের মধ্যে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। এসময় ছাত্রীর চিৎকারে স্থানীয় সোহেল এবং ছাত্রীর ভগ্নিপতি শাওন ঘটনাস্থলে পৌঁছালে হানিফকে দেখতে পান। এসময় হানিফ প্যাদার কর্মকাণ্ড শাওন মোবাইলফোনে ভিডিও ধারণ করে রাখেন। পরদিন সকালে হানিফ প্যাদার কথামতো স্থানীয় ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. শহিদুল প্যাদা স্থানীয় লোকজন নিয়ে কথিত সালিশ বৈঠকে বসেন।
সালিশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী মো. হাসান ঢালী, নলুয়াবাগী সাংগঠনিক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর ঢালী, নলুয়াবাগী সাংগঠনিক ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মো. আলমগীর ঘরামি ও যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. সোবাহান প্যাদা উপস্থিত ছিলেন। ছাত্রীর বাড়ির কাছের রাস্তার পাশে একটি চায়ের দোকানে এ সালিশ বসানো হয়।
সালিশের দিন বেলা ১১টায় ছাত্রী এবং তার ভগ্নিপতিকে ডেকে এনে কোনো কথা না শুনেই প্রথমে শাওনের বিরুদ্ধে বানোয়াট একটি ছিনতাইয়ের অভিযোগ তুলে জুতাপেটা করা হয়। এরপরে ওই ছাত্রীকে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে তাকেও এলোপাতাড়ি জুতাপেটা করা হয়। এর কিছুক্ষণ পর ছাত্রীর ভগ্নিপতি শাওন অভিযুক্ত হানিফ প্যাদার একটি ভিডিও দেখালে তা ইউপি সদস্যসহ দু-তিনজন দেখার পরেই ইউপি সদস্য ভিডিওটি তার এক সহযোগীকে মুছে ফেলতে বলে তখনকার মতো সালিশ স্থগিত করে বিকেলে আবার বসার ঘোষণা দিয়ে স্থান ত্যাগ করেন।
এর আগে একটি সাদা কাগজে ছাত্রীর বাবা, ভগ্নিপতিসহ স্থানীয় পাঁচজনের সই নেওয়া হয়। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে জড়িতকে কোনো ধরনের বিচারের আওতায় আনা হয়নি। এ ঘটনার পর থেকে ওই ছাত্রী মাদরাসায় যাওয়া বন্ধ।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলে, ‘আমি প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার পাশে একটা জঙ্গল আছিল। হানিফ আমার মুখ চাইপ্পা ধইররা জঙ্গলের মধ্যে নিয়া যায়। হে আমার জামাকাপড় খোলার সময় মুখের হাত সরে গেলে আমি চিৎকার দিলে লোকজন আমারে উদ্ধার করে।
এ ঘটনা সম্পর্কে নলুয়াবাগী সাংগঠনিক ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ও সালিশ বোর্ডের সদস্য আলমগীর ঘরামি বলেন, সালিশে আমার আসতে একটু দেরি হয়েছে। তবে আমি আসার আগেই মেম্বার উত্তেজিত হয়ে ছাত্রীর ভগ্নিপতি ও ছাত্রীকে বকাবকি করেছে। জুতাপেটা আমি দেখিনি।
তবে স্থানীয় ইউপি সদস্য ওই ছাত্রী এবং তার ভগ্নিপতির কোনো কথা না শুনেই জুতাপেটা করেছেন বলে স্বীকার করেন সালিশ বোর্ডের আরেক সদস্য নলুয়াবাগী সাংগঠনিক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর ঢালী।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. আনোয়ার হাওলাদার বলেন, শ্লীলতাহানির শিকার ওই ছাত্রীর কথা না শুনেই প্রকাশ্যে জুতাপেটা করা হয়েছে। এটা দুঃখজনক।
স্থানীয় যুবক সোহেল হাওলাদার বলেন, ঘটনার সময় ছাত্রীর চিৎকার শুনে আমি ও শাওন (ছাত্রীর ভগ্নিপতি) দৌড়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি একই গ্রামের হানিফ প্যাদা মেয়েটিকে জঙ্গলের মধ্যে জামাকাপড় ধরে টানাহেঁচড়া করছে। মাটিতে গামছা বিছানো। এমন সময় আমরা হানিফকে ধরে ফেলি। আর ছাত্রীকে উদ্ধার করি। পরদিন হানিফ উল্টো ছিনতাইয়ের কথা বলে মেম্বারকে দিয়ে সালিশ বসায়। ওইখানে মেম্বার অন্য কারও কোনো কথা না শুনে মেয়ের ভগ্নিপতি ও মেয়েটিকে জুতা দিয়া পিটিয়েছে। ঘটনার সময় মোবাইলফোনে ভিডিও করা হয়েছিল, সেটিও মেম্বার মুছে দিয়েছে।
এ বিষয়ে গোলখালীর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. শহিদুল প্যাদা মোবাইলফোনে বলেন, সব মিথ্যা। আমি কিছু জানি না।
এ বিষয়ে গোলখালী ইউপি চেয়ারম্যান মো. নাসির উদ্দিন বলেন, আমি লোকমুখে ঘটনা শুনেছি। আজ ঘটনাস্থলে যাচ্ছি।
গলাচিপা থানার ওসি শোনিত কুমার গায়েন বলেন, এ বিষয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। ঘটনার সত্যতা পেলে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন আল হেলাল বলেন, এ ঘটনায় আমি কোনো পক্ষ থেকেই অভিযোগ পাইনি। এরপরও অভিযুক্ত ইউপি সদস্যকে কারণ দর্শানোর জন্য এরইমধ্যে নোটিশ করা হয়েছে। নোটিশের জবাব পেলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।