ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী আশাপ্রকাশ করেছেন, আগামী বছর থেকে ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ প্রায় ২০০০ কোটি টাকা রাজস্ব হিসেবে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া সম্ভব হবে। এই অর্থের পরিমাণ ডিজিটাল ভূমি উন্নয়ন কর সিস্টেম স্থাপনের পূর্বে ভূমি কর বাবদ আদায়কৃত অর্থের প্রায় তিন গুণ বা ২০০ শতাংশেরও বেশি।
বুধবার (২৪ মে) বেসরকারি নীতি গবেষণা সংস্থা (থিংক ট্যাংক) সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) উদ্যোগে রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত এক হোটেলে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে সম্পত্তি কর ব্যবস্থার পরিধি ও অবস্থা’ বিষয়ক এক নীতি সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এই আশাপ্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, শতভাগ ম্যানুয়াল কর ব্যবস্থায় ২০১৯-২০ সালে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় হয় প্রায় ৬২১ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালে অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর ব্যবস্থা উদ্বোধন করার পর সারা দেশে অনলাইন এলডি ট্যাক্স সিস্টেম রোল-আউটের সময়ে অর্থাৎ ২০২১-২২ সালে আদায় হয়েছে প্রায় ৮৬৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মোট করের প্রায় ৩০ শতাংশ ভূমি উন্নয়ন কর অনলাইনে আদায়েই কর বেড়েছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা।
এসময় ভূমিমন্ত্রী আরও জানান, গত ১৪ এপ্রিল থেকে শতভাগ ক্যাশলেস সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে সারা দেশে এখন প্রায় শতভাগ ভূমি উন্নয়ন কর আদায় হচ্ছে অনলাইনে এবং এই এক মাসেই আদায় হয়েছে ৩২৫ কোটি টাকা।
ভূমিমন্ত্রী আরও বলেন, ভূমিকর ব্যবস্থাকে আধুনিক করে গড়ে তোলার জন্য ভূমি উন্নয়ন কর আইনের খসড়া ইতোমধ্যে মন্ত্রিসভায় নীতিগতভাবে অনুমোদন পেয়েছে। খুব দ্রুত এই খসড়া জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নের জন্য পাঠানো হবে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা মাথায় রেখে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের বর্ষ দেশে প্রচলিত অর্থবছরে (জুন-জুলাই) করার প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়া আইনে।
এসময় স্বাধীন বাংলার প্রথম ভূমি সংস্কারক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখেই ভূমি করের হার নির্ধারণ করা হয় আমাদের দেশে। এজন্য সর্বনিম্ন ভূমি করের হারের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
মন্ত্রী এসময় বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কর-জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) অনুপাত বাড়ানোর জন্য ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্সসহ অন্যান্য ডিরেক্ট ট্যাক্স বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার কাজ করছে। ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে বলে মন্ত্রী এসময় মতপ্রকাশ করেন। তিনি এসময় আরও মতপ্রকাশ করেন, বৈশ্বিক মহামারি, মন্দা ও বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধের পরও বাংলাদেশ অর্থনীতি স্থিতিশীল রয়েছে মূলত দেশে ধারাবাহিক সরকার থাকার কারণে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সংলাপ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
অনুষ্ঠানে সিপিডি ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ‘বাংলাদেশে সম্পত্তি কর ব্যবস্থার পরিধি ও অবস্থা’ শীর্ষক গবেষণা সমীক্ষা বিষয়ক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তার দলের গবেষণায় প্রস্তাবিত সংস্কারের জন্য তিনটি নীতি চিহ্নিত করা হয়েছে: সমতা, দক্ষতা এবং স্বচ্ছতা। এই গবেষণায় বাংলাদেশের সম্পত্তি কর পাঁচটি মাত্রার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়েছে: করের মূলভিত্তি, অব্যাহতি, মূল্যায়ন, হার এবং প্রশাসন। সমীক্ষায় যেসব পদক্ষেপগুলো সুপারিশ করা হয়েছে তা হচ্ছে: কর ফাঁকি রোধ, সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করা, ধীরে ধীরে করের হার যৌক্তিক করা, কর প্রশাসনকে শক্তিশালী করা, ডিজিটাইজেশন এবং তথ্য ব্যবস্থা প্রক্রিয়াগুলি বাস্তবায়ন করা, তথ্য প্রচারের কার্যকর করা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রবর্তন করা, উপহার করের বিদ্যমান বিধানগুলি সংস্কার করা, হেবাকে উপহার করের আওতায় আনা এবং সম্পত্তি কর উত্তরাধিকার কর প্রবর্তন করা।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধি দলের হেড অব কো-অপারেশন মোরিজিও সিয়ান সম্মানীয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান হাবিব মনসুর এবং স্নেহাশিস মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানির পার্টনার স্নেহাশিস বড়ুয়া এফসিএ প্যানেলিস্ট হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
প্যানেল বিশেষজ্ঞগণ নতুন ধরনের কর তৈরি করার চেয়ে বিদ্যমান কর ব্যবস্থাতেই দক্ষতা বৃদ্ধি করে রাজস্ব বৃদ্ধি করা, কর ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের জন্য সহজ ও বোধগম্য করা, ভূমি নিবন্ধন ব্যবস্থাকে ভূমির অন্যান্য সেবা প্রদানকারী একই মন্ত্রণালয়রে আওতাভুক্ত করা, ভিন্ন-ভিন্ন সরকারি সেবাদানকারী দপ্তরের ডাটাবেজের মধ্যে আন্তঃপরিচালন যোগ্যতা নিশ্চিত করা এবং কর বিষয়ক নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার ওপর জোর দেন।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন- বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।