মুসলিম ঐতিহ্যের ৪৪২ বছরের নিদর্শন ‘শাহী মসজিদ’

লেখক:
প্রকাশ: ২ years ago

চাটাইয়ের (বাঁশের) ওপর মোহর ঢেলে ভুষালি মালের মতো বিক্রি করা হতো বলে স্থানের নামটি হয়ে গিয়েছিল ‘চাটমোহর।’  শুধু তাই নয়, মোঘল-পাঠান-পর্তুগীজ-আফ্রিকানরাও সেই মোহরের টানে এখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। এসেছিলেন ইরান থেকে ইসলাম প্রচারে পীর আউলিয়ারাও। ফলে পাবনা জেলার ইতিহাস বাতায়নে সবদিক থেকেই চাটমোহর নামটি সমুজ্জ্বল স্থান দখল করে আছে।

এই চাটমোহরে ৪৪২ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে আজও ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট ‘শাহী মসজিদ।’ শাহী মসজিদটি বাংলার মুসলিম স্থাপত্যে একটি নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছে।

 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাবনার অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র চাটমোহর একদা ছিলো মোঘল-পাঠানদের অবাধ বিচরণ ভূমি। ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে মোঘল সম্রাট আকবরের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তারই একটি বাহিনীর সেনাপতি মাসুম খাঁ কাবলি মসজিদটি নির্মাণ করেন। বইপত্রে যা এখনো মাসুম খাঁ কাবলির মসজিদ বলেই উল্লেখ আছে। তবে মসজিদটি স্থানীয়দের কাছে ‘শাহী মসজিদ’ নামেই বেশি পরিচিত।

শাহী মসজিদটির ভেতরে দৈর্ঘ্য ৩৪ হাত, প্রস্থ ১৫ হাত, উচ্চতা প্রায় ৩০ হাত। ক্ষুদ্র পাতলা নকশা খচিত লাল জাফরী ইটে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদের দেওয়ালটি সাড়ে চার হাত প্রশস্থ। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির সামনে ইদারার গায়ে কলেমা তৈয়বা লিখিত একখণ্ড কালো পাথর এখনো রয়েছে।

 

সরেজমিনে শাহী মসজিদে গিয়ে দেখা যায়, মসজিদটিতে তিনটি প্রবেশপথ রয়েছে। মূল প্রবেশ পথটি ছাড়া অন্য প্রবেশপথ দু’টি একই ধরনের। মসজিদের তিনটি প্রবেশপথের সঙ্গে মিল রেখে পশ্চিম দেওয়ালে রয়েছে মোট তিনটি মিহরাব।  কেন্দ্রীয় মিহরাব থেকে দুই পাশের মিহরাবে রয়েছে বড় সুরঙ্গের মতো অপূর্ব নিদর্শন। ভূমি-নকশালঙ্কারে স্থাপত্য।

অনুমান করা হয়, সুলতানী-মুঘল স্থাপত্যের রীতিতে মসজিদটি নির্মিত।  মিম্বারের পাশে কষ্টি পাথরের মত কালো রংঙের পাথরটি সৌন্দর্যের আরেকটি অংশ।

মসজিদটির এক পাশে ফার্সি ভাষায় মসজিদটি নির্মাণের ইতিহাস এবং অপর পাশে বিষ্ণু ও শিবের মূর্তি অঙ্কিত একটি প্রস্তর খণ্ড ছিলো।  প্রস্তর খণ্ডটি বর্তমানে রাজশাহী বরেন্দ্র মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৮০ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটি অধিগ্রহণ করে। মূল কাঠামো অবিকল রেখে অধিদপ্তর থেকে কয়েক দফা সংস্কার করা হয়েছে মসজিদটি। এখন মসজিদটি তার অতীত সৌন্দর্য্য অনেকটাই ফিরে পেয়েছে।

সম্রাট আকবরের পাঁচ হাজার সেনার অধিনায়ক ছিলেন মাসুম খাঁ কাবলি।  তার পূর্ব পুরুষ সুলতান হুসাইন শাহ’র আমলে কাবুল থেকে এদেশে এসে চাটমোহর অঞ্চলে জায়গীর লাভ করেন এবং এখানেই বসবাস শুরু করেন। এখানেই মাসুম খাঁ’র জন্ম হয়। তার পূর্বপুরুষরা কাবুলের খোরাশানের তুরাবতী বংশের কাকশাল গোত্রের সৈয়দ ছিলেন। তার চাচা মির্জা আজিজ কাকশাল সম্রাটের উজির ছিলেন। মাসুম খাঁ মাত্র কুড়ি বছর বয়সে সম্রাট আকবরের সেনাতে যোগ দেন।

মাসুম খাঁ কাবলি বাংলার বার ভূঁইয়াদের বিদ্রোহকালে তাদের দলে যোগ দেন এবং আকবরের সেনাপতি ও গভর্নর শাহবাজ খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করেন। যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে শীতলক্ষা তীরের (গাজিপুর) গহীন অরণ্যে আত্মগোপন করেন মাসুম খাঁ। সেখানেই ৪৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

 

বর্তমানে শাহী মসজিদ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ মহল। আর পেশ ইমাম হিসাবে হাফেজ কাজী আব্দুস সালাম মাসুদ এবং মুয়াজ্জিন হিসেবে রয়েছেন তরিকুল ইসলাম।  পুরাকৃর্তি ও প্রত্মতত্ব অধিদপ্তরের পক্ষে সাইট পরিচালক হিসেবে আছেন শাহজাহান আলী।  তিনি তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই শাহী মসজিদের দেখাশুনা করছেন।

শাহজাহান আলী বলেন, নথিপত্রে চাটমোহর শাহী মসজিদটি মাসুম খাঁনের নাম পাওয়া যায়। তবে স্থানীদের কাছে এটি শাহী মসজিদ বলেই পরিচিত। সারা বছর বহু মানুষ আসেন পাবনার চাটমোহরে এই মসজিদটি দেখতে।  সংস্কারের মাধ্যমে মসজিদটির মূল কাঠামো ও সৌন্দর্য্য ধরে রাখার চেষ্টা চলছে।

মসজিদের ইমাম হাফেজ কাজী আব্দুস সালাম মাসুদ বলেন, দূর থেকে মসজিদটি বিশাল মনে হলেও এর ভেতরে রয়েছে মাত্র দুই কাতার। দুই কারাতে লোক নামাজে দাঁড়াতে পারেন। পাঁচ ওয়াক্ত ও জুমার নামাজ আদায় হয় এই মসজিদে। এছাড়া মসজিদের বাইরে দু’টি ঈদের নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় প্রতিদিন অনেকেই আসেন মসজিদটি দেখতে, ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে।

তিনি আরও বলেন, ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এমন একটি মসজিদের ইমাম হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।

যেভাবে যাবেন: ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে আন্তঃনগর ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেসে পাবনার ইশ্বরদী রেল রুটের চাটমোহর স্টেশনে আসতে সময় লাগবে সাড়ে ৪ ঘণ্টা।  স্টেশন থেকে ভ্যান বা অটোরিকশায় করে চাটমোহর উপজেলা পরিষদের সামনে যেতেই দেখা মিলবে ঐহিতাহিস শাহী মসজিদের।

চাটমোহরে ভালো মানের খাবার হোটেল রয়েছে অনেক। দুপুরে ঘুরে বিকেলে পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনে করে পর্যটকরা চাইলে ঢাকায় ফিরতে পারবেন। এছাড়া রাত্রীযাপন করতে চাইলেও চাটমোহর-পাবনা ঈশ্বরদীতে রয়েছে আধুনিক সব হোটেল-মোটেল।