সফল হওয়ার স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি। সত্যি বলতে, আমাদের যত চেষ্টা-প্রচেষ্টা, শ্রম-সাধনা; সব কিছু ওই সফলতার জন্যই। বর্তমান বিশ্বে সফল মানুষ বললেই বিলগেটস, মার্ক জাকারবার্গ, স্টিভজবস-এর নাম সবার আগে ওঠে আসবে। দূর ও নিকট অতীতের সফল মানুষের তালিকা তো বলেও শেষ করা যাবে না। আমরাও তাদের মতই সফল হতে চাই। অথবা তাদের কাছাকাছি কিংবা যেতে চাই তাদের ছাড়িয়েও অনেক দূর। কিন্তু এ স্বপ্ন কি কখনো সত্যি হবে? আমি কি পারব সেরাদের সেরা হতে? পৃথিবীজুড়ে নিজেকে মেলে ধরতে? আরো বড় প্রশ্ন হলো, এই ভবঘুরে আমাকে দিয়েই কি হবে? আমার কত সীমাবদ্ধতা, অযোগ্যতা ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকে যারা সফল, পৃথিবী যাদের সুনাম গাইছে, তারা কোনোভাবেই আপনার আমার চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিলেন না। তাদের অনেকেই দারিদ্র্য কিংবা মেধাহীনতার কারণে অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার পর্যন্ত তৈরি করতে পারেননি। শুধু কী তাই? কেউ কেউ তো শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও বিশ্বসেরা হয়েছেন।
প্রথমেই বিখ্যাত ব্র্যান্ড এ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভজবসের গল্প বলি। পৃথিবীখ্যাত এই ব্যবসায়ী জন্মে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক অবিবাহিত তরুণীর গর্ভে। অর্থাভাবে স্টিভজবসকে দত্তক দেন তার মা। ১৭ বছর বয়সে কলেজে ভর্তি হয়ে মাত্র ছয় মাসের মাথায় খরচ যোগাতে না পেরে কলেজ ছাড়তে হয় তাকে। থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, হতাশ জবস বন্ধুদের বলে-কয়ে তাদের রুমের এক কোণে ফ্লোরে থাকার জায়গা পেলেন। ব্যবহূত কোকের বোতল ফেরত দিয়ে পেতেন পাঁচ সেন্ট। এ দিয়েই চলত খাওয়া পর্ব। একবেলা ভালো খাবারের আশায় প্রতি রবিবার সাত মাইল হেঁটে হাজির হতেন উপাসনালয়ে। সেই জবসই আজকের স্টিভজবস।
এবার শুনুন আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বিখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী এ পি জে আবুল কালামের গল্প। দশ ভাই-বোনের সংসার। দারিদ্র্য জেঁকে ধরেছে তাদের পরিবারকে। এ পি জে কালাম তখন ১০ বছরের শিশু। স্কুলে ভর্তি হয়েছেন বেশিদিন হয়নি। এর মধ্যেই দারিদ্র্য তাকে চোখ রাঙাতে থাকে সকাল-বিকাল। যেন পড়তে তাকে দিবেই না। শিশু কালাম দারিদ্রের চোখ রাঙানোকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ভোর সাড়ে চারটায় ওঠে চলে যেতেন ফ্রি প্রাইভেট পড়তে। সাড়ে পাঁচটায় খবরের কাগজ ফেরি করতেন। কাগজ বিক্রি শেষে ছুটতেন স্কুলে। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে পায়ে হেঁটে শহরে যেতেন পাওনা টাকা আদায়ের জন্য। এভাবেই কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বেড়ে ওঠেন বিশ্বখ্যাত এ পি জে কালাম।
বিশ্বখ্যাত কমেডি অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনের শৈশবও সুখকর ছিল না। বাবা-মার বিচ্ছেদের পর চার্লিকে ফেলে আসা হয় এতিমখানায়। এতিমখানার চার দেয়ালের বন্দি জীবন থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন সেরাদেরও সেরা অভিনেতা। বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান প্রথম জীবনে মুম্বাই এসে পার্কের বেঞ্চিতে ঘুমাতেন। খেতেন বন্ধুদের থেকে ধার-কর্জ করে।
বিশ্বের সেরা ধনী বিলগেটসের নাম কে না শুনেছে। প্রচণ্ড মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও তিনি গ্রাজুয়েশান সম্পূর্ণ করতে পারেননি। ব্যবসার শুরুতেই খান প্রচণ্ড ধাক্কা। তারপরও তিনি নিজেকে চিনিয়েছেন বিশ্বের সেরা ধনী হিসেবে। কেএফসির প্রতিষ্ঠাতা হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডার্সেনের বিখ্যাত রন্ধন প্রণালী শুরুতেই এক হাজারের বেশি রেস্টুরেন্ট মালিক বাজে আইটেম বলে ফেলে দিয়েছিল। তারপরের গল্প আমাদের চোখের সামনেই। আজ কেএফসির নাম শুনলেই জিভে জল এসে যায় ছোট-বড় সবার।
এবার আমাদের দেশের একজনের গল্প শোনাব আপনাদের। তিনি হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। কখনো ভাবতেই পারেননি, পড়াশুনা তাঁর কপালে আছে। অভাবের সংসারে আট ভাইবোন। বড় ভাই লেখাপড়া ছেড়েছেন অর্থাভাবে। তাই কল্পনারাজ্যেও স্কুলে যাওয়ার কথা ভাবতে সাহস পাননি আতিউর রহমান। সারাদিন গরু চড়িয়ে, দুধ বেঁচে সংসার চালাতেন আতিউর ও তার বড় ভাই। একদিন ছোট্ট আতিউর ভাইকে বললেন- ‘আমাকে স্কুলে ভর্তি করাবি?’
ভাই তার মুখে কী যেন একটা দেখতে পেলেন। বললেন, ‘আমি হেডস্যারের সঙ্গে কথা বলে দেখি।’
স্কুলের প্রধান শিক্ষক আতিউরকে দেখেই বললেন, ‘সবাইকে দিয়ে পড়ালেখা হয় না।’
বড় ভাই বলল, ‘আপনি ওকে শুধু পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দিন।’
বার্ষিক পরীক্ষার মাত্র তিন মাস বাকি তখন। স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলেন আতিউর। পেটে খাবার নেই। পকেটে টাকা নেই। গায়ে ভালো জামা নেই। চলে গেলেন বন্ধু মুজাম্মিলের বাড়িতে। ওখানে থেকেই শুরু হয় ভাগ্য গড়ার লড়াই। নিজেকে আবিষ্কার করেন সেরা অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে।
বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। পরীক্ষায় ফেল করার পর পরিবার থেকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। হতাশার জীবনে আশার আলো খুঁজে পান লেখালেখির ভুবনে। আজ তিনি বাংলা ভাষার অপরিহার্য লেখক। আমাদের আল মাহমুদের গল্প জানেন? হ্যাঁ! কবি আল মাহমুদের কথাই বলছি। জীবন-সংগ্রামের শুরুতে তিনি সাইকেলে চেপে লাইফবয় সাবান ফেরি করেছিলেন। আজ তিনি জীবন্ত কিংবদন্তি। বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি।
সারকথা হলো, আজকে যারা সফল, তারাই গতকাল ব্যর্থ ছিলেন। আমাদের মতই হতাশ ছিলেন হয়ত। তবে তাদের একটি গুণ ছিল, যা আমাদের নেই। লেগে থাকা, হাল ছেড়ে না দেওয়া। আজ হয়ত আপনি চাকরি পাচ্ছেন না, ভালো রেজাল্ট করতে পারেননি, সেমিস্টার গ্যাপ আছে কিংবা স্কুলের বারান্দাও মাড়াননি কোনোদিন; তাতে কী? যদি লক্ষ্য থাকে অটুট হবেই হবে জয়।
শেষ করছি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের গল্প দিয়ে। তার আত্মজীবনীতে তিনি লিখেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার পরও অভাব আমার পিছু ছাড়েনি। এমনকি বাস ভাড়াও অনেক সময় পকেটে থাকত না। দীর্ঘপথ হেঁটে এসে ক্লাস করতাম।’ পরবর্তীকালে তিনিই হয়ে ওঠেন সফল ও তুমুল জনপ্রিয় লেখকদের একজন।
আল ফাতাহ মামুন
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়