আর মাত্র ৬ দিন বাকি দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দ্বার খুলতে। আগামী ২৫ জুন এই সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জীবনযাত্রা, অর্থনীতি আর যোগাযোগের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আশায় স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে ক্ষণগণনা শুরু করেছেন বরিশাল শহরসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। এ সেতু ঘিরে গোটা দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পের নতুন দুয়ার খুলবে এমনটাই আশা করছেন এ অঞ্চলের মানুষ। পদ্মা সেতুকে ঘিরে ইতোমধ্যে গোটা দক্ষিণাঞ্চলে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নিরবিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগের কারণে সময়ের পাশাপাশি কমাবে পণ্য পরিবহনের খরচ। স্থানীয় বলেছেন, যাতায়াতে নদীর সহজ লভ্যতা, আকাশ পথ আর এখন পদ্মা সেতুর কারণে ফেরী বিহীন সড়ক বরিশালের ব্যবসা বাণিজ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটবে।
যানবাহনের চাপে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির আশঙ্কা
২৫ জুনের পর দক্ষিণাঞ্চলের সড়কগুলোতে বাড়বে যানবাহনের চাপ। এটি বিবেচনায় রেখেই ২০১৬ সালে ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক ৪ লেন করার প্রাথমিক কাজ শুরু করে সড়ক ও সেতু বিভাগ। ২০১৮ সালে ১১ অক্টোবর ওই প্রকল্পে ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত ১৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ৬ লেনবিশিষ্ট এক্সপ্রেস সড়ক নির্মাণের অনুমোদন দেয় সরকার। ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা ও পায়রাবন্দর পর্যন্ত সড়কের দূরত্ব প্রায় ২৩৫ কিলোমিটার। এই সড়কের প্রস্থ মাত্র ২৪ ফুট। বর্তমানে এ সড়কে চলাচল করতে হিমশিম খাচ্ছে যানবাহন। মোটকথা বরিশাল সহ বিভাগের অন্যান্য সড়ক তেমন প্রশস্থ না হওয়ায় দুর্ঘটনা বৃদ্ধির আশংকাও রয়েছে। তবে বরিশাল বিভাগীয় প্রশাসনের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুতে যান চলাচলের আগেই বরিশাল শহরের ১২ কিলোমিটার সড়ক প্রশ্বস্তকরণে সড়ক ও জনপথ বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভাগীয় শহর বরিশালকে যানজটমুক্ত রাখতে নগরীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নথুল্লাবাদ থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিতে সিটি কর্পোরশনকে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বিভাগীয় প্রশাসনের এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে দ্রুতসময়ের মধ্যে বাস টার্মিনালকে কাশিপুরে নির্মিত ট্রাকস্ট্যান্ডে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন
পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। যাতায়াতের দুর্ভোগ কমিয়ে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সড়কব্যবস্থার ইতিহাসে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুুষের দূরত্ব কমবে। বাড়বে অর্থনৈতিক যোগাযোগ। এছাড়া রেল সেতু চালু হলে পদ্মা সেতুর বুক চিরে চলে যাবে ট্রেন। সেজন্য আলাদাভাবে তৈরি করা হচ্ছে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প। সেতু চালু হলে ওই এলাকার কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য বদল ঘটবে। জানা গেছে, সেতুটি চালু হলে দেশের জিডিপির পরিমাণ বাড়বে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে রাজধানী ও চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এক কথায় বদলে যাবে গোটা দেশ। এদিকে পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের বিভিন্ন জেলার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনকে সামনে রেখে পরিবহন ব্যবসায়ীরা নতুন করে ব্যবসার প্রসার নিয়ে চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছেন। জানা গেছে, দেশের নামকরা পরিবহন মালিকরা দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চল রুটে বিলাসবহুল পরিবহন সেবা চালু করতে যাচ্ছে। ওইসব পরিবহন কোম্পানির প্রতিনিধিরা দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ বাসষ্ট্যান্ডগুলোতে কাউন্টার স্থাপনের কাজ শুরু করেছেন।
কৃষি খাতে বিপ্লব
বরিশালের অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল বাংলার অর্থনীতি। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা এ অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকে দিয়ে এসেছে অফুরন্ত ধন-সম্পদ আর সীমাহীন প্রাচুর্য। প্রাচীনকাল থেকে পলি গঠিত উর্বর এ অঞ্চল ছিল কৃষির জন্য উৎকৃষ্ট এবং বসবাসের জন্য উত্তম। কৃষিই ছিল এ দেশের অর্থনীতির মূল উৎস। পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষিতে নিঃসন্দেহে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেতুর কারণে বাড়বে কৃষিপণ্যের উৎপাদন। দ্রুত স্থানবদল হবে সেসব পণ্য। নিন্ম আয়ের মানুষ কৃষিতে মনোযোগী হবেন। কাজের সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়া মানুষগুলো গ্রামে ফিরে আবার কর্মসংস্থান হিসেবে কৃষিতেই মন দেওয়ার কথা ভাবছেন তারা। পদ্মা সেতুর কারণে ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে জমির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। যে কারণে কিছু জমি বিক্রি করেও অনেকে জোগাতে পারবেন পুঁজি। দখিনের বিস্তীর্ণ চরে ধান চাষের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি কৃষিপণ্য চাষাবাদের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, বরিশালে ধান, শাকসবজি, নারিকেল, সুপারি, পেয়ারা, আমড়া, তরমুজের পাশাপাশি তেজপাতারও চাষ হয়। বাজারজাত সহজ হলে এসব অঞ্চলে বড় আকারে তেজপাতা চাষের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। বাড়বে নারিকেল ও সুপারির বাগানও। এতদিন এসব পণ্য রাজধানীতে পাঠানো ছিল দুঃসাধ্য। সেতু চালু হলে তা সহজ হয়ে যাবে। এমনটাই প্রত্যাশা এসব অঞ্চলের কৃষকদের। এদিকে স্বরূপকাঠি কুটির শিল্প কৃষিপণ্যের ওপর নির্ভরশীল। সে কারণে এখানে নারিকেলের ছোবড়ার পণ্যের (পাপোস, দড়ি) চাহিদা বাড়বে। এ অঞ্চলের গাছের চারাও দ্রুত পৌঁছানো যাবে দেশের সর্বত্র। এ সেতুকে ঘিরে ইতোমধ্যে আশপাশের জেলাগুলোতে শুরু হয়েছে শিল্পায়ন। চলছে বনায়নও। বরিশালের কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল আলম আমার সংবাদকে জানান, বরিশালে ধান, নারিকেল, সুপারির, আমড়া, পেয়ারার পাশাপাশি এখন তরমুজের চাষ হয়। এখানকার তরমুজ দক্ষিণাঞ্চলের চাহিদা পূরণ করছে। এতদিন এসব পণ্য রাজধানীতে পাঠানো ছিল দুঃসাধ্য। সেতু চালু হলে তা সহজ হয়ে যাবে। এমনটাই প্রত্যাশা এসব অঞ্চলের কৃষকদের।
ব্যবসা বাণিজ্যের পরিধি বাড়বে, অবদান রাখবে জাতীয় অর্থনীতিতে
পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে। সেতু উদ্বোধনের পর দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন সহজ হবে তেমনি গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্প ও সম্ভাবনা। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে, যা মানুষের জীবনমানকে আরো উন্নত করবে। জীবনযাত্রার প্রয়োজনে শুরু হবে নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য। পদ্মা সেতুর সঙ্গে এই অঞ্চলের অনেক অবকাঠামো উন্নত হচ্ছে। এই সেতুর কারণে আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বেড়ে যাবে। পায়রা বন্দর, পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন, ফোর লেনের পায়রা সেতু, শেরে বাংলা নৌঘাঁটি ও ইপিজেড স্থাপিত হলে পুরো দক্ষিণাঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক জোনে পরিণত হবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরেই উদ্যোক্তারা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগের ডালা খুলে বসছেন। গ্রহণ করা হচ্ছে, অসংখ্য মেগা প্রকল্প। আবাসন শিল্প, পর্যটন শিল্প, হাইটেক পার্ক, তাঁতপল্লীসহ অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে। স্বপ্নের এই সেতুর চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থনীতির পুনর্জাগরণ ঘটবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। একই সঙ্গে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ, বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পায়রা সেতু থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়কের আশপাশে দেশের ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জমি ক্রয় করেছেন। পায়রা বন্দর এলাকার আশপাশে জমি ক্রয় করেছে মদিনা গ্রুপ ও এমএম বিল্ডার্স নামের প্রতিষ্ঠান। সাগরকন্যা কুয়াকাটায় ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে শতাধিক হোটেল-মোটেল। পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার খাজুরা, গঙ্গামতী, কাউয়ার চর, ভোলা ও পটুয়াখালীর চরাঞ্চল এবং বরিশাল ও এর আশপাশে জমি ক্রয় করেছেন সিকদার গ্রুপ, ইউএস বাংলা, সেঞ্চুরি, বসুধা, ওয়েস্টার্নসহ কমপক্ষে ১৫টি ভারী শিল্পমালিক।এসবস্থানে কোম্পানিগুলো নির্মাণ করবে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কলকারখানা ও বহুতল ভবন। কুয়াকাটায় নির্মাণের অপেক্ষায় রয়েছে ১৭ তলা ভবনের ওয়াচ টাওয়ার। সরকারের মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় হবে আধুনিক পর্যটন এলাকা কুয়াকাটা। থাকবে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, স্টেডিয়ামসহ বহু স্থাপনা।
একই সঙ্গে ঝালকাঠির তাঁত শিল্প অর্থনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ন স্থান দখল করে আছে। এখানে উৎপাদিত পন্যের মধ্যে শীতলপাটি এক বিরাট স্থান দখল করে এসেছে। দুর-দুরান্ত থেকে মানুষ শীতলপাটি কিনতে গ্রীষ্মকালে ঝালকাঠিতে আসে। এছাড়া ঝালকাঠি জেলা ঐতিহাসিকভাবে লবণ শিল্পের জন্য বিখ্যাত । এ জেলায় রয়েছে ১০ টি লবণ কারখানা। আড়ৎদারী ব্যবসা ঝালকাঠির ব্যবসায়ী অংগনে এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। ডাল, মরিচ, হলুদ, গুড়, আটা, ময়দা, তেল, কাপড়, সুতা, ঔষধ-পত্র, জুতা ও মসল্লাদি ঝালকাঠির ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে আমদাণীকৃত হয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে চলছে। পদ্মা সেতু চালু এসব ব্যবসা বাণিজ্যের আরো প্রসার ঘটবে এমনটাই আশা এ অঞ্চলের মানুষের।
পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পড়বে প্রভাব
স্বপ্নের পদ্মাসেতু চালু হলে সাগরকণ্যা কুয়াকাটার সাথে সারা দেশের দূরত্ব কমবে। কুয়াকাটা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পটুয়াখালী জেলার একটি শহর ও পর্যটনকেন্দ্র। এটি বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত। এখানে আছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত যা পর্যটকদের কাছে “সাগরকন্যা” হিসেবে পরিচিত। ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সৈকত বিশিষ্ট কুয়াকাটা বাংলাদেশের অন্যতম নৈসর্গিক সমুদ্র সৈকত। এটি বাংলাদেশের একমাত্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। শুধু কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত-ই নয়। বরিশালের অন্যান্য পর্যটন সম্ভাবনাময় স্থানগুলো- বরিশালের দূর্গাসাগার, লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি, দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের বাড়ি, রায়পাশা কড়াপুরের মিয়া বাড়ি মসজিদ, গুঠিয়া মসজিদ কপ্লেলেক্স, গৈলা মনসা মন্দির, বার্থি তারা মায়ের মন্দির, ভোলার জ্যাকব টাওয়ার, চরকুকরি মুকরি, নেছারাবাদের আটঘর কুড়িয়ানায় ভাসমান পেয়ারা বাজার, নৌকার হাট দেখার জন্য পর্যটকদের আগমন বৃদ্ধি পাবে। এতে কর্মসংস্থান বাড়ার পাশাপাশি উপক‚লীয় অঞ্চলের জীবন যাত্রার মান বাড়বে।
বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা থেকে কুয়াকাটার বিস্তৃত এলাকা ঘিরে পর্যটনভিত্তিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান করতে যাচ্ছে সরকার। যার মনিটরিং করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। মাস্টারপ্ল্যানে থাকছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক পর্যটন স্থাপনা, শিল্পভিত্তিক বন্দরনগরী, পরিকল্পিত নগরায়ণ, যোগাযোগ, অর্থনীতি ও কৃষি খাতে উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ও দুর্যোগ ঝুঁকিসহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলাভিত্তিক কার্যক্রম।
২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর উম্মুক্ত হবে বরিশালের সবকটি বাণিজ্যিক দ্বার। আর দক্ষিণাঞ্চলের হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে বরিশালের এখন বাধা শুধু গ্যাস ও আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোর স্থাপন বলে জানালেন বরিশালের সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। তাদের মতে, পটুয়াখালীর পায়রা বা লেবুখালী সেতুর চালুতে বরিশাল তথা এ বিভাগের ছয় জেলার ভাগ্যোন্নয়নের বানিজ্যিক দ্বার উম্মুক্ত হয়েছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের ফলে বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হবে। আর এ যাত্রার সফলতা পেতে হলে ভোলা থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আসা নিশ্চিত করতে হবে ও খুলনা নির্ভর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বরিশাল নির্ভর হতে হবে। এটা হলেই বাণিজ্যিক নগরী হবে বরিশাল এবং এর সুফল পাবে বিভাগের ছয় জেলার প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ।
বরিশালে আসবে রেল
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চল। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পর এবার রেলপথ নেটওয়ার্কের আওতায় বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চল যুক্ত হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বইছে আনন্দের বণ্যা। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বৃদ্ধি করে ২০২২ সালের জুন নাগাদ করা হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে ছয় মাস সময় বাড়িয়ে করা হয়েছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এবার প্রথম সংশোধনীতে এর মেয়াদ আরও দেড় বছর বাড়িয়ে করা হয় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। এখন নতুন করে আবারও ২০২২ সালের জুন নাগাদ করা হলো।
বরিশাল চেম্বার অব কমার্স ইন্ড্রাস্টির সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, আর মাত্র ৭ দিন পর পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। বরিশাল তথা গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মাঝে আনন্দ-উচ্ছ্বাস ততোটাই বাড়ছে। ইতোমধ্যে সর্বস্তরে শুরু হয়েছে, ক্ষণগণনা। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বরিশালে অতিরিক্ত যানবাহনের চাঁপ বৃদ্ধি পাবে এবং এতে মানুষের দুভোর্গও বাড়বে। বিশেষ করে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল পর্যন্ত সরু সড়ক সবকিছু তালগোল পাকিয়ে দিতে পারে। এ বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীদের বেশিমাত্রায় ভাবিয়ে তুলছে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) প্রলয় চিসিম বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বেড়ে যাবে, সারাদেশের সাথে যোগাযোগ সহজ হবে, উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। দক্ষিণাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষি পণ্য সহজ যোগাযোগের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌছানো যাবে। ফলে কৃষকরা লাভবান হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পেলে ট্রাফিক বিভাগে জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি ট্রাফিকের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়া হবে যাতে করে মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে না হয়।
বরিশাল মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলবাসী পদ্মা সেতু নিয়ে উচ্ছসিত। এ সেতুটি আমাদের স্বপ্নের সেতু। একটা সময় বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চল ছিল অবহেলিত। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কারণে এখন আর বরিশাল অবহেলিত থাকবে না। এ সেতুকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধিপাবে। অসংখ্য শিল্প কারখানা মালিকরা এ অঞ্চলে ইতিমধ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। যা বাস্তবায়ন হলে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, বরিশাল হবে শিল্প বাণিজ্যের হেডকোয়াটার। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এ সেতুটি বাস্তবায়ন করেছেন যা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হতো না।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোঃ সাদেকুল আরিফিন বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষ সারাদেশের সাথে সংযুক্ত হবে। এছাড়া দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে এ সেতুটি বিশেষ ভুমিকা রাখবে। এ সেতুটি চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সেক্ষেত্রে দক্ষিণাঞ্চলে আগামীর বরিশাল হবে বাণিজ্য ও শিল্প নগরী। পায়রা তাপু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্র বন্দর ও কুয়াকাটা সৈকত এগুলোকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির সহজলভ্যতার কারণে শিক্ষা ও সস্কৃতি বিষয়ে বিপ্লব ঘটবে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে গতিশীলতা বাড়বে তাতে কিছুটা গতি হারাবে সড়ক পথ। কেননা দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক বিশেষ খরে ভাঙা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত যে সড়ক রয়েছে তার প্রশস্ত করা একান্ত প্রয়োজন।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরিশালের সভাপতি অধ্যাপিকা শাহ সাজেদা বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। এ সেতুটির ফলে দক্ষিণাঞ্চল আর অবহেলিত থাকবে না। ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প নিয়ে নতুন নতুন মেরূকরণ শুরু হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের যে উর্ধ্বগতি হচ্ছে পদ্মা সেতুটি চালু হলে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এটি সহজলভ্য হবে এবং মানুষ কম মূল্যে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য কিনতে পারবেন। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়ে। এ সেতুটি চালু হলে সারাদেশের সাথে সহজ যোগাযোগ করতে পারবেন এবং এ অঞ্চলের শিক্ষার মান আরো বাড়বে। পদ্মা সেতু চালু হলে এ অঞ্চলের সড়কগুলোতে যানবাহনে চাপ বাড়বে এটা মাথায় রেখে সড়ক প্রশস্তকরণ করার কথা বলেন তিনি।
শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন বলেন, পদ্মা সেতু একটি আত্মমর্যাদার নাম, একটি সাহসের নাম, বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার নাম। পদ্মাসেতু দক্ষিণাঞ্চলবাসীকে অহংকার ও মর্যাদার জায়গায় নিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন এজন্য আমরা গর্বিত। পদ্মা সেতুর কারণে বরিশাল হবে ভবিষ্যত শিল্প ও বাণিজ্য নগরী। এতে করে একদিকে যেমন সারাদেশের সাথে এ অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ সহজ হবে তেমনি বাড়বে কর্মসংস্থান। তবে এর পাশাপাশি সেতু চালু হওয়ার পর সরু সড়কপথের কারণে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ার আশংকাও রয়েছে। এজন্য খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফোরলেন সড়ক ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।
বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আমিন-উল আহসান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় ইতোমধ্যে পায়রা সেতু চালু হওয়ায় বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ফেরীবিহীন যোগাযোগ শুরু হয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার সাথে ঢাকাসহ সারাদেশের ফেরীবিহীন যোগাযোগ শুরু হবে। দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুরু হবে নতুন অধ্যায়। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে।