অ্যাকাউন্টে টাকা নেই, লেনদেন সাড়ে ১০ হাজার কোটি

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগ ওঠা ৫০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টির ব্যাপারে তদন্ত শেষ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সংস্থাটি। পরে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে পণ্য কিনতে গিয়ে পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা টাকা গ্রাহকদের ফেরত দিতে করা পৃথক তিন রিটের ওপর শুনানির জন্য আগামীকাল ২২ মে দিন ঠিক করেছেন হাইকোর্ট। গত ২১ এপ্রিল হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে এমন ১৭টির মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা নেই বললেই চলে। বাকি টাকা কোথায় গেছে সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য প্রতিবেদনে নেই। এসব প্রতিষ্ঠান অর্থপাচার করেছে কি না, সে ব্যাপারেও কিছু বলা হয়নি।

 সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকা কোথায় ব্যবহার করা হয়েছে, সিআইডির মাধ্যমে তদন্ত করে এর খাত বের করা উচিত। একই সঙ্গে বাংলাদেশের যে ই-কমার্স রেভ্যুলেশন, প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণকারী আইন নেই। দ্রুত আইন প্রণয়ন করা উচিত। অন্যথায় ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও বড় সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিএফআইইউর পক্ষে তাদের আইনজীবী হাইকোর্টকে জানিয়েছেন, ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, কিউকমসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের অর্থ কোথায় গেছে, পাচার হয়েছে কি না সে ব্যাপারে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্ত চলছে।

হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে বিএফআইইউর প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে জানান সংস্থার আইনজীবী। এরপর আদালত এ বিষয়ে শুনানির পরবর্তী দিন ঠিক করেন। ওইদিন আদালতের শুনানিতে রিটকারীদের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবীর পল্লব ও অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল।

এ বিষয়ে একটি রিটের পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, বিএফআইইউ ১৭টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনে এসব প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর টাকা কোথায় গেছে সে ব্যাপারে প্রতিবেদনে কিছুই বলা হয়নি। বিএফআইইউ হাইকোর্টকে জানিয়েছে, অর্থপাচারের বিষয়টি সিআইডি তদন্ত করছে।

শুনানির দিন রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ।

 বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সরাসরি এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে। ই-কমার্সের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যেসব টাকা অ্যাকাউন্টে জমা আছে সেগুলো ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের কোনো আপত্তি নেই। এখন পুরো বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক জানে সুতরাং ব্যাংকের বিষয়টি তারা ছেড়ে দিলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো অসুবিধা নেই।

এ বিষয়ে আইনজীবী হুমায়ুন কবির পল্লব বলেন, অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগ ওঠা ৫০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টির ব্যাপারে আংশিক তদন্ত শেষ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট। এরপর এ বিষয়ে শুনানির জন্য ২২ মে দিন ধার্য করেন আদালত।

তিনি বলেন, প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করার জন্য আদালত ২২ মে পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তাদের প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছে। দাখিল করা প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করে আদালত পরবর্তী আদেশ দেবেন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে এমন ১৭ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোয় প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা নেই বললেই চলে। বাকি টাকা কোথায় গেছে সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য প্রতিবেদনে নেই। এসব প্রতিষ্ঠান অর্থপাচার করেছে কি না, সে ব্যাপারেও কিছু বলা হয়নি।

তবে বিএফআইইউর পক্ষে তাদের আইনজীবী হাইকোর্টকে জানিয়েছেন, ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, কিউকমসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের অর্থ কোথায় গেছে, পাচার হয়েছে কি না সে ব্যাপারে পুলিশের অপরাধ গোয়েন্দা বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে।

এর আগে হাইকোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৫ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি ডটকমের ১৩টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৬৭টি হিসাবের আনুষঙ্গিক দলিলাদি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

হিসাবগুলোতে লেনদেনের বিবরণী থেকে জানা গেছে, ইভ্যালি ডটকম লিমিটেড ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নামে প্রাপ্ত ৩৬টি হিসাবে (সঞ্চয়ী চলতি) মোট ৩৮৯৮ দশমিক ৮২ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।

এর মধ্যে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জমা প্রায় ১৯৫৬ দশমিক ১৯ কোটি টাকা ও উত্তোলন হয়েছে প্রায় ১৯৪ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত সেলিম রেজা, ফরিদ হোসোইন, তারিক রহমান রাকিবুর ৫০ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করেছেন। ৩৬টি অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট-ট্যাক্স আদায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পলিসি কী, তা জানার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টে সংশ্লিষ্টরা এ প্রতিবেদন জমা দেন।

গত ২৫ নভেম্বর এ বিষয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে শুনানি হয়। এর আগে আদেশ অনুযায়ী শুনানিতে এ বিষয়ে প্রতিবেদন না পেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি গত ১৬ নভেম্বর উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন হাইকোর্ট।

গত ২০ সেপ্টেম্বর ই-কমার্সের গ্রাহকদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় জাতীয় ডিজিটাল কমার্স পলিসির ম্যান্ডেট অনুসারে একটি স্বাধীন ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা চেয়ে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আনোয়ারুল ইসলাম।

২৩ সেপ্টেম্বর ই-অরেঞ্জে কোটি কোটি টাকা আটকে থাকা ৩৩ জন গ্রাহক ডিজিটাল বা ই-প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তৈরির জন্য অর্থনীতিবিদ, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, ব্যবসায়ী ও অন্য অংশীজনদের নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন এবং ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট করেন। তাদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মোহাম্মদ শিশির মনির। ২২ সেপ্টেম্বর মানবাধিকার সংগঠন ল’ অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশন, ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জের দুজন গ্রাহকের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির পল্লব আরেকটি রিট করেন।

রিটে কোনো ব্যক্তি বা সরকারি কর্তৃপক্ষের অবহেলা বা ব্যর্থতায় ইভ্যালি, আলেশা মার্ট, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, দারাজ, কিউকম, আলাদিনের প্রদীপ ও দালাল প্লাসের মতো পরিচিত বাজার থেকে পণ্যের জন্য লাখ লাখ গ্রাহকের ক্ষতি ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা নির্ণয়ে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারকের নেতৃত্বে এক সদস্যবিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়। ওই তিন রিট একত্রে শুনানি নিয়ে গত ২৮ সেপ্টেম্বর আদালত আদেশ দেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আইনজীবী ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল জানান, হাইকোর্টের নির্দেশে যেসব করা দরকার সবকিছু করতে মন্ত্রণালয় প্রস্তুত। গেটওয়েতে আটকে থাকা টাকার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অবগত। সুতরাং তারা যে সিদ্ধান্ত নেবেন তাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সাধুবাদ জানাবে।

আর বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ জানান, আদালতে আসা প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি পুরোপুরি অবগত নন।

সর্বশেষ গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ই-কমার্সের দুর্নীতি বিষয়ে পৃথক তিনটি রিটের ওপর একসঙ্গে শুনানি হয়। ওইদিন ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ সব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা কোথায় গেল, কীভাবে এসব টাকা হস্তান্তর হয়েছে, এক্ষেত্রে যে অর্থপাচার হয়েছে- সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট থেকে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানতে চান হাইকোর্ট।

একই সঙ্গে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক লেনদেনের বিপরীতে ভ্যাট-ট্যাক্স আদায়ে কী পলিসি নেওয়া হয়েছে, আদৌ কোনো পলিসি আছে কি না কিংবা ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় করা হয় কি না-সে ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআরকে) জানাতে বলা হয়। পাশাপাশি ই-কমার্স খাতের স্বার্থে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের করা ১৬ সদস্যের কমিটির কার্যপরিধি কী তাও জানতে চান আদালত। সে অনুযায়ী গত বছরের নভেম্বরে একটি আংশিক প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

এরপর চলতি বছরের ২১ এপ্রিল বিএফআইইউ একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এতে বলা হয়, মিডিয়া এবং রিটের তথ্য অনুযায়ী ৫০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিএফআইইউ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৭টির ব্যাপারে তদন্ত শেষ করেছে। বাকিগুলোর ব্যাপারে তদন্ত সম্পন্ন করতে আরও সময় প্রয়োজন।

ই-ভ্যালি লিমিটেড: ই-ভ্যালির নামে ছয়টি মার্চেন্ট মোবাইল হিসাব ও ১১টি ব্যাংক হিসাবসহ প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও এমডি মো. রাসেলের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের নামে মোট ৮২টি হিসাবের তথ্য পাওয়া যায়। তার মধ্যে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে উল্লেখযোগ্য লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে এমন ছয়টি মার্চেন্ট মোবাইল হিসাব, আটটি ব্যাংক হিসাব, সাতটি ঋণ হিসাব ও ১১টি ক্রেডিট কার্ড হিসাবের লেনদেন পর্যালোচনা করে বিএফআইইউ প্রতিবেদন দিয়েছে।

এসব হিসাবে মোট ৬ হাজার ২৯৭ দশমিক ৩১ কোটি টাকা জমা হয়। জমা করা অর্থের মধ্যে ২৫৬ দশমিক ৫১ কোটি টাকা নগদে উত্তোলন এবং ৯ হাজার ৫৪৮ দশমিক ৭৬ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ট্রান্সফার করা হয়েছে।

ই-অরেঞ্জ শপ ও অরেঞ্জ বাংলাদেশ: এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ১৩টি হিসাব খুলে লেনদেন করা হয়। এসব হিসাবের মাধ্যমে মোট ২ হাজার ১৪৮ দশমিক ২০ কোটি টাকার লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানের নামে ২৪টি হিসাব পরিচালনা করে লেনদেন সম্পাদন করা হয়েছে মর্মে পরিলক্ষিত হয়। এসব অ্যাকাউন্টে সন্দেহভাজন দুই ব্যক্তি কর্তৃক ১২০ কোটি টাকার লেনদেন সম্পাদন করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বুমবুম লিমিটেড ও বুমবুম ডটকম: ২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে জুন পর্যন্ত চার মাসে মোট আটটি হিসাব খুলে লেনদেন করা হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের নামে। তিনটি ব্যাংকের এই আটটি হিসাবে মোট ৫৮ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে অ্যাকাউন্টগুলোয় ৪ দশমিক ১৩ লাখ টাকা জমা আছে।

কিউকম লিমিটেড: প্রতিষ্ঠানটি মোট ২২টি হিসাব খুলে লেনদেন করেছে। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করা এসব হিসাবে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৯২ দশমিক ৩৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে বর্তমানে ৫৭ দশমিক ৩২ কোটি টাকা জমা রয়েছে।

গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ই-কমার্স গ্রাহকদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় জাতীয় ডিজিটাল কমার্স পলিসির ম্যান্ডেট অনুসারে একটি স্বাধীন ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা চেয়ে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আনোয়ারুল ইসলাম। পরে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর মানবাধিকার সংগঠন ল’ অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশন এবং ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জের দুজন গ্রাহকের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব একটি রিট করেন।

এই রিটে সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির সমন্বয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যাদের গাফিলতির কারণে ইভ্যালি, আলেশা মার্ট, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, দারাজ, কিউকম, আলাদিনের প্রদীপ ও দালাল প্লাসের মতো পরিচিত ই-কমার্স কোম্পানি থেকে প্রতারিত হয়ে লাখ লাখ গ্রাহক সর্বস্বান্ত হয়েছেন তাদের চিহ্নিত করে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ, ই-কমার্স কোম্পানি থেকে পাচার করা অর্থের পরিমাণ নিরূপণ করে দুদকের মাধ্যমে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, বাংলাদেশ ব্যাংককে এ পর্যন্ত ইভ্যালি, ধামাকা, আলেশা মার্ট, কিউকম, দালাল, ই-অরেঞ্জ, আলাদিনের প্রদীপ, দারাজ, ইত্যাদিতে মোট কত টাকা লেনদেন হয়েছে এবং গ্রাহকরা মোট কত টাকা দিয়েছে তা চিহ্নিত করার কথা বলা হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত কতগুলো প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়েছে এবং তারা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২ অনুযায়ী, ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়াসহ ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারি, অসম প্রতিযোগিতা রোধ, জনসচেতনতা তৈরি ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া, জাতীয় ডিজিটাল বাণিজ্য নীতি, ২০১৮ অনুযায়ী দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে হেল্প ডেস্ক অবিলম্বে চালু করতে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

পরে গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর ই-অরেঞ্জের কাছে আটকে থাকা টাকা উদ্ধারে ৩৩ জন গ্রাহক একটি রিট করেন। এই রিটে ই-অরেঞ্জসহ অন্যান্য অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোয় রিসিভার নিয়োগের, অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীল ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা প্রদান এবং গ্রাহক ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং সুষ্ঠু পরিচালনার নিমিত্তে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়ার জন্য অর্থনীতিবিদ, তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের আর্জি জানানো হয়। এ রিটের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মোহাম্মদ শিশির মনির।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ সঙ্গে আলাপকালে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি বলেছেন, আমি বিষয়টি অবগত হওয়ার পরে বলতে পারবো।

ই-কমার্স ৫০টি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ১৭টির বিষয়ে আংশিক প্রতিবেদনের বিষয়ে রিটকারী আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, পৃথক তিনটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে এবং পরবর্তী শুনানির জন্যে আগামী ২২ মে দিন ঠিক করেছেন আদালত। ওইদিন এর অগ্রগতি নিয়ে শুনানি হবে।

শিশির মনির আরও বলেন, এই যে সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকা কোথায় ব্যবহার করা হয়েছে, সিআইডির মাধ্যমে তদন্ত করে এর খাত বের করা উচিত। একই সঙ্গে বাংলাদেশের যে ই-কমার্স রেভ্যুলেশন, প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণকারী আইন নেই। আইন দ্রুত প্রণয়ন করা উচিত। অন্যথায় ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও বড় সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে ভোক্তা অধিকার। কিন্তু কীভাবে এটা নিয়ন্ত্রণ করবে? বাংলাদেশ ব্যাংকের গেটওয়ে সিস্টেম পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তারা এটা এখনও সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে রেভ্যুলেশনগুলো আছে, নিয়মনীতি আছে সেগুলো যদি এস্টাব্লিস্ট না করে তা হলে ভবিষ্যতে আরও বড় আশঙ্কা রয়েছে।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আইনজীবী ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অবস্থান সরাসরি এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে। ই-কমার্সের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যেসব টাকা অ্যাকাউন্টে জমা আছে সেগুলো ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের কোনো আপত্তি নেই।

তিনি বলেন, টাকা ফেরতের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যতো সহযোগিতার প্রয়োজন সেটা দিতে তারা প্রস্তুত। এখন পুরো বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক জানে সুতরাং ব্যাংকের বিষয়টি তারা ছেড়ে দিলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো অসুবিধা নেই।

কোর্ট যখন যে নির্দেশনা দেবেন তার বিষয়েও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রস্তুত বলে জানান মন্ত্রণালয়ের এই আইনজীবী।