তাসকিনের আগুনঝরা বোলিংয়ের পর জয়টা প্রায় বাংলাদশের হাতের মুঠোতেই চলে এসেছিল। বাকি ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা। সেই আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার দায়িত্ব ব্যাটারদের ঘাড়ে। দেখার ছিল, তারা কতটা স্বচ্ছন্দে সেই দায়িত্ব পালন করেন।
বোলাররা দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১৫৪ রানে অলআউট করে দিয়ে ম্যাচকে যতটা সহজে পরিণত করেছিলেন, ব্যাটাররা সেই সহজ কাজটাতে আরও সহজ করে নিলেন। বিশেষ করে অধিনায়ক তামিম ইকবাল। অপর ওপেনার লিটন দাসকে নিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে ১২৭ রানের জুটি গড়ে বাংলাদেশের জয়কে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসেন তিনি।
শেষ পর্যন্ত লিটন আউট হয়ে গেলেও সাকিব আল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে সেঞ্চুরিয়নের সুপার স্পোর্টস পার্কে মাত্র ২৬.৩ ওভারে ৯ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে ম্যাচ জিতে ইতিহাস গড়ে মাঠ ছাড়লেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। দক্ষিণ আফ্রিকার মত পরাশক্তিধর দেশের মাটিতে গিয়ে তাদেরই বিপক্ষে এই প্রথম সিরিজ জয়ের ইতিহাস রচনা করলেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা।
যে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে এর আগে কোনো ফরম্যাটে একটিও জয় ছিল না বাংলাদেশের, সেখানে শুধু ম্যাচ জয়ই নয়, সিরিজ জয় রীতিমত অবিশ্বাস্য একটি ব্যাপার। বাংলাদেশের ক্রিকেট উন্নতির দুর্দান্ত একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে এই সিরিজ জয়।
জয়ের জন্য ১৫৫ রানের সহজ লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পাড়ি দিতে গিয়ে তাকে মোটেও কঠিন করে তুললেন না দুই ওপেনার। বরং, তামিম ইকবাল বিধ্বংসী ব্যাটিং করে বাংলাদেশের জয়কে আরও সহজ করে দেন। লিটনকে অন্যপ্রান্তে দর্শক বানিয়ে একের পর শর্ট খেলতে থাকেন তিনি। যে কারণে দেখা গেছে, ১০ম ওভারে কাগিসো রাবাদার মত বোলারকে চারবার বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের ভক্ত সমর্থকরা ধারণা করেছিল, ১০ উইকেটের ব্যবধানেই বুঝি জয়টা আসতে যাচ্ছে। কিন্তু ১২৭ রানের জুটি গড়ার পর ২১তম ওভারের ৫ম বলে কভারে দাঁড়িয়ে থাকা টেম্বা বাভুমার হাতে ক্যাচ তুলে দেন। বোলার ছিলেন কেশভ মাহারাজ। ৪৮ রানের মাথায় আউট হয়ে গেলেন লিটন। বল খেললেন ৫৭টি।
লিটন আউট হওয়ার পর জয়ের জন্য ফিনিশিং টাচ দিতে মাঠে নামেন সাকিব আল হাসান। তামিম-সাকিব মিলে বাকি কাজ শেষ করে ফেলেন আর মাত্র ৫ ওভারেই। ২৬.৩ ওভারেই জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। হাতে বাকি ছিল তখনও ১৪১ বল (২৩.৫ ওভার)।
তামিম ইকবাল অপরাজিত থাকলেন ৮৭ রানে। ৮২ বলে খেলা ইনিংসটি তিনি সাজিয়েছেন ১৪টি বাউন্ডারির সাহায্যে। ওয়ানডেতে নিজের ক্যরিয়ারে এটা তামিমের ৫২তম হাফ সেঞ্চুরি। ২০ বল খেলে ১৮ রানে অপরাজিত ছিলেন সাকিব আল হাসান। দেশে নিজের তিন সন্তান, মা, শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। তবুও, দেশের জন্য সিরিজ জয়ের লক্ষ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার সিদ্ধান্ত নেন সাকিব। শেষ পর্যন্ত তিনি লক্ষ্যে সফল হলেন, ইতিহাস গড়তে পারলো বাংলাদেশ।
আজ ম্যাচের শুরুতেই বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলে দিচ্ছিল, ভালো কিছু হতে যাচ্ছে। টস জিতে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাট করতে নামার পর প্রথম ওভারেই শরিফুল যেভাবে বল হাতে আগুন ঝরাচ্ছিলেন, তা ছিল অবিশ্বাস্য। তার দ্বিতীয় বলেই পরাস্ত হন ওপেনার জানেমান মালান।
আউটের আবেদন করেছিলেন তিনি। আম্পায়ার আউট না দেয়ায় খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই শরিফুল রিভিউ নিতে বলেন তামিমকে। রিভিউ নেন অধিনায়ক। যদিও আউট হয়নি। কিন্তু শরিফুলের সেই আত্মবিশ্বাস যেন ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো দলের মধ্যেই।
শেষ পর্যন্ত সেই আত্মবিশ্বাসের বলেই মাত্র ১৫৪ রানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে অলআউট করে দিয়েছে বাংলাদেশ। তাসকিন নিয়েছেন ৫ উইকেট।
প্রোটিয়া ব্যাটাররা যখন ব্যাট করছিল, তখন মনে হয়েছিল সেঞ্চুরিয়নের এই উইকেট বুঝি বোলারদের স্বর্গরাজ্য। কিন্তু বাংলাদেশের দুই ওপেনার যখন ব্যাট করতে নামলেন, তখন মনে হচ্ছে এটা বুঝি ব্যাটারদের স্বর্গরাজ্য।
জয়ের জন্য ১৫৫ রানের সহজ লক্ষ্য। এই রান করতে নেমে শুরুতেই বিপদ ঘটিয়ে বসতে পারতেন ওপেনার লিটন দাস। একেবারে প্রথম ওভারেই কাগিসো রাবাদার বলে থার্ড স্লিপে ক্যাচ তুলে দেন লিটন। কিন্তু সেখানে প্রোটিয়া ফিল্ডার কেশভ মাহারাজ বলটি তালুবন্দী করতে পারেননি। বেঁচে যান লিটন, বেঁচে যায় বাংলাদেশের ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন।
এরপর বিপদে পড়তে পারতেন তামিম ইকবালও। লুঙ্গি এনগিদির একটি বল ঠিকমত খেলতে পারেননি। ব্যাটে লেগে বলটা পিচ করে স্ট্যাম্পের একেবারে কাছেই। কান ঘেঁষে বুলেট যাওয়ার মত অবস্থা। সমূহ বিপদ থেকে বেঁচে যান তামিম। বেঁচে যায় বাংলাদেশও।
ব্যাট করতে নেমে প্রথম ৫ ওভারের মধ্যে এই দুটি বিপদ থেকে রেহাই পাওয়ার পর বলা যায় শুভ সূচনাই হয়েছে বাংলাদেশের। দুই ওপেনারের উইকেট ধরে রেখে প্রথম ৫ ওভারে এসেছে ১৯ রান।
এর আগে টস জিতে ব্যাট করতে নেমে তাসকিন আহমেদের বোলিং তোপে মাত্র ৩৭ ওভারে ১৫৪ রানে অলআউট হয়ে যায় স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা। শুরুটা ভালো করেছিল তারা। ৬ ওভারের মধ্যে ৪৫ রান পার হয়ে যায়। ৬.৫ ওভারে মেহেদী হাসান মিরাজের বলে প্রথম উইকেট হারায় প্রোটিয়ারা। আউট হন কুইন্টন ডি কক, ১২ রানে।
জানেমান মালান করেন সর্বোচ্চ ৩৯ রান। এছাড়া কেশভ মাহারাজ ২৮, ডোয়াইনে প্রিটোরিয়াস ২০ রান করেন। ডেভিড মিলার করেন ১৬ রান। বাকি ব্যাটারদের কেউই আর দুই অংকের ঘর স্পর্শ করতে পারেননি।
তাসকিন আহমেত ৯ ওভারে ৩৫ রান দিয়ে নেন ৫ উইকেট। ওয়ানডেতে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার ফাইফারের দেখা পেলেন তাসকিন। সাকিব আল হাসান নেন ২ উইকেট। শরিফুল এবং মেহেদী হাসান মিরাজ নেন ১টি করে উইকেট। ২৮ রান করা কেশভ মাহারাজ হন রানআউট।