৭০০ টাকা বিনিয়োগে মনিরার মাসে বিক্রি ৪০ হাজার টাকা

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

মনিরা জামান মুক্তা। রংপুরের পীরগঞ্জের মেয়ে। থাকেন বগুড়ায়। সম্প্রতি অনলাইনে ‘রেডি টু কুক’ পণ্য বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তার স্বামী হামিদুজ্জামান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হলেও আত্মনির্ভরশীলতার তাড়না থেকে ঘরে বসে অনলাইনে পণ্য বিক্রির পরিকল্পনা করেন। এরপর মাত্র ৭০০ টাকা বিনিয়োগ করে এখন সফল উদ্যোক্তা। ঘরে বসে প্রতি মাসে গড়ে ৪০ হাজার টাকার ‘রেডি টু কুক’ পণ্য বিক্রি করছেন তিনি।

মনিরা জানান, স্বামীর চাকরির সুবাদে স্বামী-সন্তান আর ছোট ভাইকে নিয়ে বগুড়া শহ‌রের ধরমপুর এলাকার ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছেন। তার স্বামীর বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায়। রেডি টু কুক ব্যবসা শুরুর আগে তিনি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু সন্তান জন্মদানের পর তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। এদিকে স্বামী হামিদুজ্জামান সকালবেলা অফিসে চলে গেলে তিনি একা হয়ে পড়তেন। সারাদিন তার ছোট বাচ্চা আর ফেসবুক ইন্টারনেট নিয়ে শহুরে জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। তবে ফেসবুকটাকে তিনি ইতিবাচক হিসেবেই ব্যবহার করতেন। তিনি দেখতেন অনেকেই পোশাকের প্রমোশন ফেসবুকে করছেন। তিনিও তৈরি পোশাকের উপর ব্লক এবং বাটিকের কাজ পারেন। প্রথমে পোশাক আইটেম নিয়েই ফেসবুকে ব্যবসা শুরুর উদ্যোগ নেন। সেসময় কিছু পণ্য বিক্রিও হয়েছিল তার। কিন্তু পোশাক আইটেমে প্রতিযোগিতা অনেক হওয়ায় তিনি সফল হতে পারছিলেন না।

এদিকে ছোট বাচ্চা নিয়ে রান্না করা বিশেষ করে একদিন তার স্বামী বাজার থেকে ছোট মাছ কিনে নিয়ে আসার পর মাছ কাটতে গিয়ে বাচ্চা নিয়ে খুব সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলেন। খুব বিরক্ত লাগছিল তার। এরপরেই তিনি কল্পনা করেন ছোট বাচ্চা নিয়ে যখন তিনি নিজে যেমন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন, তাহলে অন্য নারীদেরও একই অবস্থা হতে পারে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত দেন ছোট মাছসহ যে পণ্যগুলো খেতে দারুণ কিন্তু রান্না করতে অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়, সেগুলো নিজে করে বিক্রি করবেন।

এরপর ২০১৯ সালের ২০ আগস্ট প্রথম ৭০০ টাকা দিয়ে একটি ইলিশ মাছ কিনে সেটি রান্নার উপযোগী করে ছবি তুলে ফেসবুকে প্রচারণা চালান। মুহূর্তেই সেটি ক্রেতারা লুফে নেন। এরপর আর তিনি থেমে থাকেননি। একে একে তার আইটেমে যোগ করেছেন সব ধরনের ছোট মাছ, হাঁসের মাংস, কবুতরের মাংস, গরু ও খাসির ভুঁড়িসহ আরও বেশ কিছু রেডি টু কুক পণ্য। বর্তমানে তিনি দিনে ৪ থেকে ৫টি আইটেমের অর্ডার পেয়ে থাকেন। প্রতিটি পণ্য বিক্রি করছেন ৩০ শতাংশ লাভে। ডেলিভেরি চার্জ নেন মাত্র ২০ টাকা।

মনিরা জামান বলেন, নারীরা কোনো কিছু করতে গেলে বাধা আসেই। প্রতিকূল অবস্থার মধ্য থেকেই সংগ্রাম করে উঠে আসতে হয়। যখন এটা শুরু করতে যাই, সেসময় আমার স্বামী আপত্তি জানালেও এখন তিনি নিজেই যদি সময় পান, তাহলে বাজার করে সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া, পণ্য ডেলিভারির ক্ষেত্রে তার ছোট ভাই রাকিবুল ইসলাম আমাকে সহযোগিতা করেন। তবে যখন এটা শুরু করি, তখন আমাকে প্রতিবেশীদের অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে। তারা বলতেন, ‘এরকম ভুঁড়ি পরিষ্কার করে রান্নার উপযোগী করা, ছোট মাছ কেটে দিয়ে টাকা নেওয়া, এসব মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজের সামিল’। এসব কারণে এর আগে যে বাড়িতে ভাড়া করে থাকতাম, সেটা ছেড়ে দিয়েছি। নতুন যেখানে এসেছি, এখানে সবাই ভালো। আমাকে খুব উৎসাহ দেন। আমার ব্যবসা খুব ভালো হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমি ‘বগুড়া বিজনেস কেয়ার’ নামে ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করি। আমার অধিকাংশ ক্রেতা চাকরিজীবী নারী। এ ছাড়া, কিছু চাকরীজীবী পুরুষও আছেন, যারা চাকরির সুবাদে বগুড়ায় পোস্টিং হয়েছেন। আমি ফ্রোজেন ফুড বিক্রি করি না। অর্ডার পাওয়ার পর বাজারে গিয়ে কিনে টাটকা পণ্য বিক্রি করি। এজন্য ক্রেতারা আমার ওপর সন্তুষ্ট।

বগুড়ার বেসরকারি একটি ক্লিনিকের নার্স হোসনে আরা বলেন, মনিরার এমন উদ্যোগ আমার জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ আমি কর্মব্যস্ততার কারণে রান্নার সময় ঠিকমতো পাই না। কিন্তু মনিরা যে রেডি টু কুক পণ্যগুলো বিক্রি করছেন, তার কারণে একটু টাকা বেশি লাগলেও অল্প সময়েই আমি রান্নার কাজটা সেরে ফেলতে পারছি।

মনিরার ভাই রাকিবুল ইসলাম জানান, তিনি পড়াশোনা’র পাশাপাশি তার বোনকে সহযোগিতা করছেন। বিশেষ করে বাজার করা এবং পণ্য ডেলিভেরি দেওয়ার কাজ তিনিই করেন। তার বোন ব্যবসা করে সফল হয়েছেন এবং তাকে সহযোগিতা করতে পেরে তিনি খুশি।

বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক ডা. রাইসা তাহসিন বলেন, আমাকে বেশিরভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। যে কারণে শখ থাকলেও ছোট মাছ, হাঁসের মাংসসহ আরও বেশি কিছু খাবার আছে, যেগুলো কাটতে অনেক সময় লাগে, সেগুলো খেতে পারতাম না। এরপর যখন জানতে পারলাম তিনি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে এগুলো প্রস্তুত করে বিক্রি করছেন, তখন থেকে আমি তার কাছে যখন যেটা খেতে ইচ্ছে করে, নিয়মিত অর্ডার করি।