৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। বরগুনার ইতিহাসে স্মরণীয় দিন। এদিনে বরগুনাবাসী হানাদার মুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধে বরগুনা ছিল নবম সেক্টরের বুকাবুনিয়া সাব-সেক্টরের অধীন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরে বরগুনার মুক্তিকামী সহস্রাধিক তরুণ বাঁশের লাঠি, গুটি কয়েক রাইফেল, বন্দুক নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করে। এরই মধ্যে পাকবাহিনী দুর্বল প্রতিরোধকে উপেক্ষা করে পার্শ্ববর্তী পটুয়াখালী জেলা দখল করে ফেলে।
ব্যাপক ধ্বংস যজ্ঞ ও ক্ষয়-ক্ষতির ভয়ে বরগুনার মুক্তিযোদ্ধারা এলাকা ছেড়ে চলে যান, কেননা পাক বাহিনীর মোকাবেলা করার মতো তাদের কোন অস্ত্র ছিলনা। পাক বাহিনী বিনা বাধায় বরগুনা শহর দখল করে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বরগুনার বিভিন্ন থানা ও তৎকালীন মহাকুমা সদরে পাক বাহিনী অবস্থান করে পৈশাচিক নারী নির্যাতন ও নির্বিচারে গণহত্যা চালায়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, বরগুনার সাবেক সাংসদ ও বর্তমান জেলা চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন স্মৃতি চারণে জানান, ২৯ ও ৩০ মে বরগুনা জেলখানায় ৭৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো। সময়ের ব্যবধানে কয়েক মাসের মধ্যেই বরগুনার মুক্তিযোদ্ধারা শক্তি অর্জন করে মনোবল নিয়ে এলাকায় ফিরে আসেন।
বরগুনা, বামনা, বদনীখালী ও আমতলীতে যুদ্ধের পরে পাকবাহিনীর সদস্যরা বরগুনা ট্রেজারী ও গণপূর্ত বিভাগের ডাকবাংলোয় অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধা হেড কোয়ার্টারের নির্দেশ পেয়ে বুকাবুনিয়ার মুক্তিযোদ্ধারা ৭১ এর ২ ডিসেম্বর বরগুনা বেতাগী থানার বদনীখালী বাজারে আসেন।
রাত তিনটার দিকে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সত্তার খানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নৌকা যোগে বরগুনার খাকদোন নদীর পোটকাখালী স্থানে অবস্থান নেন। সংকেত পেয়ে ভোর রাতে তারা কিনারে উঠে আসেন। তারা দলে ছিলেন মাত্র ২১ জন। যাদের মধ্যে ১০ জন বরগুনার ও বাকী ১১ জন ঝালকাঠির।
স্মৃতিচারণ করে মুক্তিযোদ্ধারা জানান, কারাগার, ওয়াপদা কলোনী, জেলা স্কুল, সদর থানা, ওয়ারলেস ষ্টেশন, এসডিওর বাসাসহ বরগুনা শহরকে কয়েকটি উপ-বিভাগে ভাগ করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা যে যার অস্ত্র নিয়ে অবস্থান অনুযায়ী শীতের সকালে ফজরের আজানকে যুদ্ধ শুরুর সংকেত হিসেবে ব্যবহার করেন। আজান শুরুর সাথে সাথে ৬টি স্থান থেকে একযোগে ফায়ার করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। দ্বিতীয় দফা ফায়ার করে তারা জেলখানার দিকে এগোতে থাকেন।
চারজন সহযোগীসহ সত্তার খান ছিলেন, কারাগার এলাকায়। তারা এসময় জেলখানায় অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকারদের আত্মসমর্পন করিয়ে এসডিও অফিসের সামনে নিয়ে আসেন।
কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা গিয়ে স্বাধীনতাকামী তৎকালীন এসডিও আনোয়ার হোসেনকে আত্মসমর্পন করান। ৩ ডিসেম্বর দুপুর ১২ টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশাসনিক দায়িত্ব এসডিওকে সাময়িকভাবে বুঝিয়ে দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে বুকাবুনিয়া সাব-সেন্টারে চলে যান।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও সাংবাদিক নেতা আনোয়ার হোসেন মনোয়ার জানিয়েছেন, বরগুনা জেলা সদর হানাদার মুক্ত হওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর তারিখে আরেকটি এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের তাড়িয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে সেটি বামনা উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। আমতলী ও তালতলী উপজেলা ১৪ ডিসেম্বরে মুক্ত হয়েছিল।